২০২১ র বিধানসভা নির্বাচনে ঘাটাল বিধানসভা আসনে পরাজিত হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী শঙ্কর দোলই। এই পরাজয় তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত। নিজের জয়ের ব্যাপারে তিনি একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন। তাঁর অনুগামীরা ধরেই নিয়েছিলেন, দাদা এবার মন্ত্রী হচ্ছেনই। কোনও কোনও আত্যুৎসাহী শঙ্করভক্ত জোড়া পাঁঠা মানতও করেছিলেন। ফল বেরোনোর আগে পর্য্যন্ত শঙ্করের হাবভাব ছিলো এমনই। গণনার দিন বেলা যত গড়িয়েছে সাপ লুডো খেলার মতো উঠতে নামতে উঠতে নামতে এক সময় থেমে গেলেন তিনি। কেন এমন হ‘ল? ২০২১ সালের মে মাসের দু তারিখ ছিলো রবিবার। ছুটির দিন সাধারণত আনন্দের দিন। কিন্তু সেই রবিবারের বিকেল বেলায় গণনা কেন্দ্র থেকে থমথমে মুখ নিয়ে যখন শঙ্করবাবু বেড়িয়ে আসছেন তখন অন্য প্রান্তে অনেক তৃণমূল কর্মীকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছি। যেন তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সেদিন তাঁদের আড় চোখে দেখেছিলেন কী না জানি না সেই পরাজয়ের কারন তিনি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মাত্র ৯৬৬ ভোটার ব্যবধানে হার ! দুটো বুথ ক্যাপচার করলেই তো হয়ে যায়! হারের পিছনে গদ্দারি করলো কে? তাঁরা কারা? শঙ্কর নিজে নয় তো? উত্তর খুঁজলেন শ্রীকান্ত পাত্র
•তার আগে শঙ্করবাবুর রাজনীতির কেরিয়ারের দিকে তাকানো যাক। ছাত্র জীবনে কলেজ রাজনীতিতে কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ করতেন তিনি। কলেজ জীবন ছেড়ে আশির দশকের শুরুতে সিপিএমের হাত ধরে হয়ে গেলেন পঞ্চায়েত প্রধান। সিপিএমের সঙ্গে বেশিদিন ঘর করতে পারেননি শঙ্কর দোলই । ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ শঙ্করকে তাড়িয়ে দিল সিপিএম। বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর ঘাটালের কংগ্রেস নেতা জগন্নাথ গোস্বামীর ‘হাত’ ধরলেন। বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে শঙ্কর মাথায় ‘ইট’ নিয়ে ঘুরলেন গোটা ঘাটাল। তারপর আবার চুপচাপ। এদিকে বামেরা তখন নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো তৃণমূলের ঘাসফুল জাপটে ধরলেন। তখনই কেল্লা ফতে। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট পেয়ে বিধানসভায় ঢুকে পরলেন শঙ্কর। তারপর দাপটে কাটালেন দশ বছর। ছিপছিপে শঙ্কর হয়ে উঠলেন নাদুসনুদুস। ২০২১ র নির্বাচনে বিজেপির কাছে শঙ্করের মধ্যপ্রদেশ অনেকটাই চুপসে গেল। কেন? দায়ী কে?
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শঙ্কর ১৬ হাজারের বেশি ব্যবধানে জিতেছিলেন। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯হাজার ৪৩৯। ২০২১এর ঝড় গোটা রাজ্যে বয়ে গেলেও ঘাটালে তা থমকে দাঁড়ায়। তিনি হেরে যান। কেন হারলেন? এবার তা দেখা যাক। তাঁর বিধায়ক জীবনের প্রথম পাঁচ বছর তিনি ঠিকই ছিলেন। দলের নেতা কর্মীদের নিয়ে ভালোই চলেছেন। ইতিমধ্যেই ২০১৪ র লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হয়ে গিয়েছেন দেব। চলছিল ভালোই। গোল বাঁধলো দ্বিতীয় দফায়। ২০১৬ য় বিপুল ভোটে জিতে ‘ধরা কে সরা জ্ঞান’ করতে শুরু করলেন শঙ্কর। নিজেকে ঘাটাল ব্লক তৃণমূলের ঊর্ধ্বে মনে করতে লাগলেন। ব্লক তৃণমূল নেতাদের এড়িয়ে নিজের ইচ্ছে মতো চলতে লাগলেন তিনি। ঠিক এই সময়ই তাঁর চারপাশে জুটে গেলেন কিছু স্তাবকের দল। যারা শঙ্করের আঙ্গুলি হেলনে একের পর এক অনৈতিক কাজ করতে শুরু করলেন। শুরু হল সীমাহীন তোলাবাজি আর ধমক ধামক। এই সময়ই হয়ে গেলেন ঘাটাল কলেজের চেয়ারম্যান। ব্লক তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে ছেলেকে কলেজ ইউনিয়নের কর্তা বানিয়ে দিলেন।
শেষের শুরু তখনই। নানান অভিযোগে বিদ্ধ হতে লাগলেন পিতা-পুত্র। অভিযোগ উঠতে লাগলো কলেজে মদের আসর বসত নিয়ম করে। ছাত্র সংসদের লক্ষ লক্ষ টাকা নয়ছয়র অভিযোগও উঠলো। মুখ ফেরাতে লাগলো ছাত্র নেতারা। ব্লক জুড়ে একের পর এক নিজের অনুগামী তৈরী করে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে লাগলেন তিনি। যা ব্লক তৃণমূলের মূল স্রোতের নেতারা মেনে নিতে পারেননি। নিজের অনুগামী মনসুকার কিঙ্কর পন্ডিতকে একাধিক পদে বসানো, অসিত দেড়ের চাল গম চুরির অভিযোগকে পাত্তা না দেওয়ায় একাংশর বিরাগভাজন হতে লাগলেন শঙ্কর। নিচু স্তরের নেতা কর্মীদের উপর খবরদারি, হুমকি ক্রমশ আসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। ফলে অনেকে নিচু তলার কর্মী বিজেপিতে চলে যান শুধু শঙ্করকে টাইট দেওয়ার জন্য। নির্বাচনের আগে তলে তলে মহিলা তৃণমূল কর্মীরা রাগে ফুসছিলেন। হোয়াটস্যাপে ‘বিকৃত চ্যাট’ পাঠিয়ে বহু মহিলা তৃণমূল কর্মীর কাছে ভিলেন হয়ে গিয়েছিলেন। তার প্রমাণ মিলেছে মনসুকার পঞ্চায়েত প্রধান পুতুল পাত্রের বয়ানে। শঙ্করবাবুর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল এই সময়। এছাড়া আইসিডিএস এবং প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে নানান নিয়োগ নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেনের অভিযোগে বিদ্ধ হলেও কোনও পাত্তা দেননি শঙ্কর।
আইসিডিএস কর্মী নিয়োগ নিয়ে মহকুমা শাসকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া অনেক দূর গড়িয়েছিল। মহকুমা শাসক অসীম পালকে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়ে মুখ পুড়েছিল শঙ্করের। নির্বাচনের আগে মনসুকার এক যুবক শঙ্করবাবুর বিরুদ্ধে তাঁর কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে কয়েক লক্ষ টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলে বাড়ি বাড়ি প্রচার করেছিলেন। এর ফলে মনসুকার ১৮ কোটি টাকার ভগবতী সেতুর শিলান্যাস ঢাকা পড়ে যায়। এক কথায় দ্বিতীয় বার বিধায়ক হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দলের আন্দরে কান পাতলেই তা শোনা যায়। ব্লক তৃণমূল সভাপতি দিলীপ মাজিকে এড়িয়ে বহু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে দেখা গেছে। নিজে ১১ টি সরকারি পোষ্ট দখল করে সুপার ইমেজ তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা মেনে নিতে পারেননি অনেক তৃণমূল নেতা কর্মী। ঘাটালের শিশু মেলা, বিদ্যাসাগর মেলা নিয়েও শঙ্করের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রথম সারির তৃণমূল নেতা কর্মীরা। মন্টু বাইরিকে পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ বানিয়ে ‘ফোর পার্সেন্ট’ কারবার মানতে পারেননি অনেকেই। দলের তহবিল গড়ে ওঠার বদলে হাতে গোনা শঙ্কর ঘনিষ্ট নেতাদের পকেট ভরে ওঠাকে মানতে পারেননি একাংশ।.
সবশেষে খড়ার পুরসভায় শঙ্করের প্রশাসক বনে যাওয়া চটিয়ে দিয়েছে ওই এলাকার তৃণমূল নেতা কর্মীদের। ফলে খড়ার পুর এলাকায় বিপুল হার হয়েছে শঙ্করের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘাটাল কলেজের পরিচালন সমিতিতে সাংসদ দেবকে হটিয়ে শঙ্করের ক্ষমতা দখল। যা মেনে নিতে পারেননি দেবের অনুগামীরা। তলে তলে শঙ্করের হারের পথ সুগম করেছে তাঁরাই। বহু তৃণমূল নেতা কর্মী শঙ্করকে হারানোর জন্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। এছাড়া ঘাটালের বিডিও অরিন্দম দাশগুপ্ত মূলগ্রামের মাঠে বিপুল পরিমাণ জমি কেনার পিছনে শঙ্করবাবুর মদত দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল যা মেনে নিতে পারেননি ওই এলাকার কর্মীরা।
পাপের ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছে মিডিয়ার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। রাজ্য স্তরের সংবাদ মাধ্যমকে ফোনে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি। ফলে হিতে বিপরীত হয়েছে ভোটার ফলে। লক্ষ্য করে দেখবেন, নির্বাচনে মিডিয়া মাইলেজ পান নি শঙ্কর। এই সময় এক শ্রেণির নিম্ন মানের মিডিয়া পারসন নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে শঙ্করবাবুকে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া এক কর্মীকে ফোনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার হুমকি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে উঠেছিল তা কে না জানে! ক্ষমতার দাম্ভীকতার ফলে এক প্রকার নিজেই নিজের গদ্দার হয়ে উঠলেন শঙ্কর। রাজনীতির বিজ্ঞান বলছে, একটি বিধানসভা আসনে দুই বারের বিধায়কের ৯৬৬ ভোটের হার কোনও সাংগঠনিক ঢিলেমির জন্য নয় ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষণ এটা। মনসুকা, ইড়পালা, সুলতানপুর, ঘাটাল পুরসভা, খড়ার পুরসভায় বিপুল ভোটে হেরেছেন তিনি। শঙ্কবাবুর বহু অনৈতিক কাজকে মেনে নিতে না পারলেও কোনও নেতা কর্মী কিন্তু সাবোতাজ করেন নি। এভাবে একের পর এক ঘটনা, কার্যক্রম, ব্যক্তিগত, অনৈতিকতা সমূহ ভুল বার্তা ছড়িয়েছে জনমানসে। ছাত্র যুব মহিলার একটি বড় অংশ যারা বঞ্চিত হয়েছে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এক ঝটকায়। তার প্রভাব পড়েছে ভোট বাক্সে। শঙ্করবাবুর অনুগামীরা বারবার গদ্দার খুঁজতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনও গদ্দার খুঁজে লাভ নেই উনি হেরেছেন ওনার নিজের দোষেই।