তৃপ্তি পাল কর্মকার: সোনার কাজ করে বলেই কী ওরা ব্রাত্য? ওদের পরিচয় ওরা সোনার কারিগর। ওদের হাত ধরেই বিশাল এক আর্থ সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। ওদের উপার্জনে আজ গ্রামে গ্রামে কংক্রিটের দোতলা–তিনতলা বাড়ি। নিজের বাড়ির লোকেদের মুখে সোনার হাসি দেখবে বলে নিজেদের সোনার শৈশব–বাল্যকাল বিসর্জন দিয়ে ওদের পাড়ি দিতে হয় ভিন্ রাজ্যে, সোনার কাজে। ছবিটা এক দশক, দুই দশক বা আরও আগেকার। সেখানে গিয়েই যে সোনার কাজে হাতে খড়ি হয়ে যায় এমন নয়।ছোটো ছোটো ছেলেগুলিকে বেশ কয়েক মাস থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত খিদমত খাটতে হত মালিকের। নাস্তা–পানি আনা, রান্না করা, চার-পাঁচ তলায় জল তোলা, ঘর মোছা আরও কত কী! কচি কচি হাতে সময়ের মধ্যে সবকিছু পেরে না উঠলে সাধারণ চড় থাপ্পড় খাওয়া কিম্বা গরম বাঁকনলের ছ্যাঁকা পাওনাটা দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে থাকে। উপরি পাওনা হয়, মা–মাসি তুলে গালিগালাজ।ওই পরিস্থিতির মধ্যেই ওদের দিন কাটাতে হয়। তারপর টুকটাক একটু একটু করে যন্ত্রপাতি চেনা। খিদমত খাটার নতুন কেউ এলে তবে আগের জন বসতে পারত কারিগরের আসনে। শৈশব–কৈশোর হারিয়ে যেত অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধ আর ঠুকঠুক শব্দের মধ্যে। স্বল্প পরিসর, অল্প জায়গার মধ্যে একভাবে এক পোজে কাজ করে যেতে হয় দিনের পর দিন। মাস ফুরোলে বেতন পাঠাতে হয় ‘দেশে’। ওরা গ্রামকে, নিজের জন্মভিটেকে দেশ বলে সম্বোধন করে থাকে।বছরে একবার বা দুবার বাড়ি আসা সেটাই ওদের জীবনে আনে খোলা অক্সিজেন। এটা বড় সত্যি কথা যে ওদের গ্রাম–পরিজনদের প্রতি যে টানটা রয়েছে সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মধ্যে সেটা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষজনই সোনার কারিগরদের একটু হীন চোখে দেখে থাকে।গ্রামের উন্নয়নে টাকা লাগবে, গরিব কন্যাদায়গ্রস্থ বাবাকে তাঁর মেয়ের বিয়ের দায় থেকে উদ্ধার করতে হবে —এসব ক্ষেত্রে আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসে সোনার কাজের ছেলেরা। তবু সমাজে প্রাপ্য সম্মান ওরা পায় না। সমাজে ওদের খাটো করে দেখাটাই যেন অন্যান্য পেশার মানুষের ‘স্ট্যাটাস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত সমাজের চোখে ওরা মাতাল–লম্পট।প্রত্যেক পেশাতেই কিছু ‘কুলাঙ্গার’ রয়েছে। মাতাল–লম্পট উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করার উদাহরণ তো শিক্ষিত বা অন্যান্য পেশার মানুষের মধ্যেও যথেষ্ট রয়েছে। বরং শিক্ষিত বা অন্য পেশার বেশ কিছু মানুষ রয়েছে যাদের ‘বিজ্ঞানসম্মত ভাবে’ বেশ কিছু অসামাজিক কাজ করার প্রবণতা থাকে।সমাজের সৃষ্ট জীব হিসাবে তাই ওদের মধ্যেও রয়েছে কিছু অন্য প্রকৃতির মানুষ। তাদের দেখে সবাইকে বিচার করা ঠিক নয়। বরং শিক্ষিত বা অন্যান্য পেশার মানুষের থেকে ওদের তফাৎ যে জায়গায় সেটা ওদের উদার মন। ওরা কিন্তু শিক্ষিত সমাজকে যোগ্য সম্মান দেয়। বিনিময়ে ট্যারা–বাঁকা চাউনি ছাড়া আর কিছুই পায় না। সমাজ ওদের একটু সম্মান দিলেই ওরা খুশি। ‘দেশের’ মানুষের থেকে একটু ভালো ব্যবহার আশা করাটা কি সোনার কারিগরদের খুব অন্যায্য দাবি?