ঘাটাল মহকুমা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজো অতীতের জমিদার, দেওয়ান, খাজাঞ্চি বা কোথাও কোথাও সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত পুজো এখনও প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আভিজাত্যের কৌলিন্য হারালেও নিয়মের তেমন ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই সব পুরনো দুর্গাপুজোর দেবী দুর্গা কোথাও অষ্টাদশভূজা আবার কোথাও রাজ রাজেশ্বরী রূপে পুজো গ্রহণ করেন। মহকুমায় ওই ধরনের বেশ কয়েকটি পারিবারিক পুজো রয়েছে। আমাদের ‘স্থানীয় সংবাদ’-এর পক্ষ থেকে এবার চারটি পারিবারিক পুজোর কথা তুলে ধরা হল। পরিবারগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিবেদনটি লিখেছেন দেবাশিস কুইল্যা
•হরীতকীতলার চক্রবর্তীদের পুজো: দাসপুর থানার বলিহারপুর ও হরেকৃষ্ণপুরের হরীতকীতলার দেবী দুর্গা অষ্টাদশভূজা পঞ্চমুণ্ডি আসনে অধিষ্ঠাত্রী। চৈতন্যের যুগের সমকালীন প্রচলিত এই দুই পুজোর আদিপুরুষ বাণীভূষণ চক্রবর্তী স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে এই পুজো প্রথম প্রবর্তন করেন হরেকৃষ্ণপুরে। পরবর্তী সময়ে বাণীভূষণের কনিষ্ঠপুত্র সর্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য একই ধরনের পুজো চালু করেন বলিহারপুরে। একই পরিবারের পুজোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে বাণীভূষণ প্রবর্তিত নিয়ম মেনেই পুজো হয়। বিষ্ণুপুরি রীতি অনুযায়ী দুর্গা প্রতিমার কাঠামোয় প্রাচীন চালচিত্র লক্ষ্য করা যায়। দেবীর গাত্র বর্ণ শিউলি ফুলের বোঁটার রং। নবম ম্যাদি কল্প অনুসারে পুজো হয়। পুজোর বিশেষত্ব; দুটি নবপত্রিকা স্থাপন করা হয়। একটি জীতাষ্টমীর সন্ধ্যায় বেলতলায় দেবীর অধিবাস ও আমন্ত্রণের সময়। অপরটি মহাষষ্ঠীতে। আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমীতে আদ্রানুশাস্ত্র যোগে দেবীর বোধন শুরু হয়। জীতাষ্টমীতে এবং মহাষষ্ঠীতে ঘট ও নবপত্রিকা স্থাপনের পর প্রতিনিয়ত পুজো ভোগ চণ্ডীপাঠ হয়। বিসর্জন মহাদশমীতেই। বাণীভূষণ কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘দুর্গাচ্চা- কল্প-মঞ্জরী’ অনুযায়ী এখানকার পুজোর মন্ত্র পড়া হয়। কচু, পুঁইশাক, চিংড়ি মাছের ঝোল সহকারে ভোগ নিবেদন হয় প্রতিদিন। দশমীতে পান্তা ভাত দেওয়া রীতি আছে। হরেকৃষ্ণপুরের হরীতকীতলায় বর্তমানে ছাগ বলি হলেও ১৯৭৮ সালের পর তা বন্ধ হয়ে গেছে বলিহারপুরে। বর্তমান সময়ে আর্থিক অনটন সত্ত্বেও দুই জায়গায় নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে পুজো করে আসছে বাণীভূষণের বর্তমান উত্তরসূরী।
•পুরুষোত্তমপুরে ঘোষ পরিবারের পুজো: পুরুষোত্তমপুরে বর্ধমান রাজার দেওয়া দেবোত্তর সম্পত্তির উপর নির্ভর করে আঞ্চলিক জমিদার রঞ্জিত ঘোষ প্রায় সাড়ে চার’শ বছর পূর্বে পুজো প্রচলন করেন। রঞ্জিত ঘোষ ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্ম এখন রায় পদবি ব্যবহার করেন। এখানের দশভূজা দুর্গার চালচিত্র কংস নারায়ণ রীতি অনুযায়ী এক কাঠামোর। শাক্ত মতে দেবী দুর্গার পুজো হয় নবমীতে, ছাগ বলি হলেও মায়ের ভোগ রান্না হয় না। পুজোর প্রতিদিন কুড়ি সের শুকনো আতপ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এখানের পুজোয় তিনটি নব পত্রিকা স্থাপন করা হয়। প্রথমটি আশ্বিনের জীতাষ্টমীতে। দ্বিতীয়টি শুক্লা চতুর্থীতে। উদ্দেশ্য; তৎকালীন সময়ে বর্গী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ওইদিন দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করা। আর তৃতীয়টি মহাষষ্ঠীর দিন। প্রতিমা মৃন্ময়ী হলেও হেম ঘটে পুজো গ্ৰহণ করেন দেবী দুর্গা। এখনও পুরনো রীতি মেনে পুজোর দিনগুলোতে এখানে প্রতি সন্ধ্যায় রামেশ্বর চক্রবর্তী রচিত ‘শিবায়ন’ অনুষ্ঠিত হয়।
•দাসপুরের চৌধুরী পরিবারের দুর্গা পুজো: দাসপুর গঞ্জের চৌধুরী পরিবারের পুজোটিও প্রায় সাড়ে তিন’শ বছরের পুরোনো। রাজা শোভা সিংহের অধীনস্থ তৎকালীন আঞ্চলিক জমিদার বঙ্গরাম চৌধুরি দুর্গা পুজো প্রচলন করেন। দেবী এখানে দশভূজা রাজ রাজেশ্বরী। প্রতিমার কাঠামো একচালা বিশিষ্ট প্রাচীন পৌরাণিক দেবী মূর্তি । পূর্বে নবমম্যাদি কল্প অনুসারে পুজো হয় । এখন ষষ্ঠাদিকল্প অনুসারে পূজা হয়। পূর্বের রীতি বজায় রেখে এখনও ছাগ বলি প্রথা চালু আছে। মাঝে কিছু বছরের জন্য এই পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও চৌধুরী পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম নতুন ভাবে পুরনো রীতি অনুসরণ করেই পুনরায় চালু করেছে।
•সিহ বাড়ির পুজো:দাসপুর থানার সয়লা গ্রামের সিংহ বাড়ির পুজো। ১৭২২ থেকে এই পুজো সাবেকি ঘরানায় অনুষ্ঠিত হয়। পরিবারের সদস্য সুকান্ত সিংহ জানালেন, গম্ভীর চরণ সিংহ জমিদারের কাজ তদারকির সময় কংসাবতীর শাখা, পলাশপাই খালে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পান এবং বাড়ি নিয়ে আসেন। সেই থেকে কংসাবতীর মাটি দিয়েই সিংহ বাড়ির প্রতিমা তৈরি হয় ও সিংহ বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে। আগে পশু বলি হত এখন হয় না। এই পরিবারের দুর্গা খুব মিষ্টি রসিক হওয়ায় নৈবেদ্যে থালা ভর্তি মিষ্টি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো পরিবারের আর্থিক অনটন সংকটেও পরিবারের সদস্যরা এখনও চালিয়ে আসছেন। ঐতিহ্যের পরম্পরা মেনে দেবীর বোধন শুরু হয় ও বিসর্জন দশমীতেই।
•দাস পরিবারের পুজো:দাসপুর থানারই রাধাকান্তপুরের দাস পরিবারের পুজো ২৮০ বছরের পুরোনো। পরিবারের বর্তমান সদস্য সনৎকুমার দাস জানালেন, রাজা শোভা সিংহের দেওয়ান শ্যাম দাস শোভা সিংয়ের অজান্তে পুকুর খনন করলে পাইক পাঠিয়ে মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ দেন। পুকুর খননের সময় সেই কাটা মুণ্ডু তিনবার দুর্গানাম উচ্চারণ করে। পরবর্তী প্রজন্মের যোগেশ্বর দাস স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মৃন্ময়ী দুর্গা পুজো প্রচলন করেন। শাক্ত মতে দেবী পূজিত হন। অষ্টমীর দিন দেবী এখানে বৈষ্ণবী রূপে পুজো গ্ৰহণ করেন। নবমীর সন্ধ্যায় ওলাইচণ্ডী তলায় অলকা দেবীর পুজো করা হয়। এখানে বলি শুরু হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির পুজোর নবমীতে কামানের আওয়াজ শুনে। দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পর এই পরিবারের রীতি অনুসারে প্রত্যেক পুরুষেরা দুর্গা মন্ত্র কাগজে লেখেন। সেই সঙ্গে দুর্গা-জপ ১২ বার লিখে মণ্ডপের চালে রাখা হয়। এর পর প্রত্যেকে দই মঙ্গল করে বাড়িতে যান।
•পণ্ডিতদের পুজো: দাসপুর বাসুদেবপুরের বেথুয়া বাটির পণ্ডিতদের পুজো প্রায় সাড়ে চার’শ বছরের পুরোনো। পরিবারের সদস্যা দিয়াসিনী ঠাকুরানী কালীর পুলের সামনে ঘট সহ সাত দেবীমূর্তি কুড়িয়ে পান। কালী, মনসা, শীতলা, বিশালাক্ষী, সিদ্ধেশ্বরী, পার্বতী ও কামিনী হেম ঘটের উপর আসীন এরাই পূজিত হন দুর্গা রূপে। বোধনের দিন থেকে। এখানে নবমীর দিন কামান দেগে বলি শুরু হয়। এখানের কামানের শব্দ শুনে পাশাপাশি গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের পুজোর বলিদান শুরু হয়। বিসর্জনের প্রথা মেনে সমস্ত কিছু হলেও হেম ঘট ওদেবীর বিসর্জন হয় না। শুধু পুজোয় ব্যবহৃত ফুল পত্র বিসর্জন করা হয়।
•কর্মকারদের পুজো:ঘাটালের আর এক ঐতিহ্য মণ্ডিত পুজো শহরের কোন্নগরের কর্মকারদের সিংহবাহিনী দুর্গা পুজো। ১৪০৯ খ্রীষ্ঠাব্দে জমিদার হরিহর কর্মকার প্রতিষ্ঠিত সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা রূপে পূজিত হন। প্রায় ৫৩০ বছরের এই পারিবারিক দুর্গা পুজো হয় সমস্ত নিয়ম মেনেই। কথিত আছে বর্ধমানের সিংহ দরজার আদলে সিংহ বাহিনী দেবীর দরজা বানানোয় তৎকালীন বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিরাম মেহতাবের বিষ নজরে জিতারাম কর্মকার পড়লে দেবী স্বয়ং স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে আদেশ দেন জিতারামকে মুক্তি দিতে। মুক্তি দেওয়ার সাথে সাথে দেবীর সেবার জন্য ৫০ বিঘা জমিও দান করেন বর্ধমানের রাজা। কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবীর ঘট ভাসানের মাধ্যমে এখানে দেবীর বিজয়া হয়।