ধর্ম নয়, আমরা মানুষ—এটাই হোক আমাদের বড় পরিচয়

মেহেবুব আলম:পৌষ মাস। অনেকের বাড়িতেই পিঠে তৈরি হচ্ছে। ছোটবেলায় প্রচুর খেয়েছি। মা তৈরী করত নারকেল দিয়ে। আমার অবশ্য বেশি ভালো লাগতো বাঁধাকপি বা আলুর পুর দেওয়া পিঠেগুলো। নারকেল ছাড়া অন্য পুর দেওয়া পিঠে মা দু’একবার বানিয়েছিল কিনা আমার মনে পড়ে না। তবে বাঁধাকপি বা আলুর পুর দেওয়া পিঠে অনেক খেয়েছি। এই পিঠেগুলো আসতো বাবার বন্ধু ও প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে। সেদিন জানতাম না, ওদের আর আমাদের ধর্ম আলাদা।
সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলে সবাই একসঙ্গে খিচুড়ি খেয়েছি। তখন মিড-ডে মিল ছিল না। স্কুলে একসঙ্গে খাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ ছিল। একবার পুজোর সময় স্কুল থেকে টিম করে চাল ও টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম প্রতিবেশী এলাকাগুলোতে। তখনও জানতাম, পুজোটা স্কুলের পুজো। একবারও মনে হয়নি, এটা কেবল একটা নির্দিষ্ট ধর্মের। স্কুলের এক শিক্ষকের বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোয় গিয়েছি, খেয়েছি। পুজো মানেই খাবার একটা উপলক্ষ্য। সাহেবের বড়দিন, ঈদ, সবেবরাতগুলোও তাই। স্কুলের সরস্বতী পুজোর আয়োজন, ডেকোরেশনের কাজে অংশগ্রহণ করেছি। বন্ধুদের বাড়িতে থাকা মন্দিরের ভেতরে ঢুকেছি, পিতলের মূর্তিকে হাতে নিয়ে দেখেছি। তখন কেউ নিষেধ করেনি। এখন কেউ কেউ মন্দিরে ঢুকতেই নিষেধ করে।
সংবাদপত্রে দেখলাম, উত্তরপ্রদেশে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে প্রাক্তন সহপাঠীর সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল এক কিশোর। সহপাঠী এক দলিত কন্যা আর কিশোর মুসলিম। তাদের ধর্ম আলাদা এই অভিযোগে একদল লোক তাদের মারধর করে। পুলিশ ছেলেটিকে গ্রেফতার করে কেস দিয়েছে। ছোট থেকে বড় হওয়ার পর্বে আমার বাবা-মা, আমার ধর্মপ্রাণ দাদু, স্কুলের শিক্ষকেরা, আমার প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনেরা কখনও আমাদের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি। বলা ভালো, দুটি ধর্মকে কখনও আলাদা করে ভাবতে শেখায়নি। হায়! সমাজটা কেমন যেন বদলে গেল। হঠাৎ একদিন মানুষ থেকে মুসলিম হয়ে গেলাম। এখন আমাকে প্রায় শুনতে হয়, আমার এক মুসলিম বন্ধু আছে, খুব ভালো মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে এমন একটা ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, যেন মুসলিমদের ভালো মানুষ হওয়াটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। এবং আমাকে দেখলেই তাদের এসব কথা মনেও পড়ে। মানে মানুষকে তারা ধর্মের বাইরে ভাবতেই পারছেন না। বিদ্বেষের মানসিকতা গড়ে উঠছে উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যেই।
খ্রিস্টান পরিবার থেকে আসা সব ছেলে-মেয়ে যেমন বড়দিন পালন করেন না, তেমনই খ্রিস্টান পরিবারের বাইরের লোকজনও তার তার মতো করে বড়দিন পালন করে বা এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটা ঈদ, দুর্গাপুজোর মতো ধর্মভিত্তিক উৎসবগুলোর ক্ষেত্রেও কম বেশি সত্য। অনেকে ভাবতেই পারছে না, কোনও ধর্মে নেই এমন সংখ্যক মানুষ বা ধর্মীয় পরিবার থেকে আসা ধৰ্ম মেনে না চলা মানুষের সংখ্যা কম নয়। ধর্মের মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে সুড়সুড়ি দিয়ে চুলকানি থেকে খুনোখুনিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারেরও অবদান প্রচুর।
অনেককেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার কথা বলতে শুনি। সম্প্রীতি মানে হিন্দু মুসলিমের সম্প্রীতি। আমি মুসলিম, তুমি হিন্দু এই পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে থাকলে কি যথার্থ সম্প্রীতি গড়ে তোলা সম্ভব? ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে সবাই মানুষ – এভাবেই তো ভাবা উচিত। সব ক্ষেত্রেই এভাবে ভাবতে পারা চাই, যেটা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আমরা বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পেরিয়েছি। তাঁর স্বপ্ন ছিল, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, প্রাদেশিকতা – এই সব কিছুর বাইরে আমাদের বড় পরিচয় হবে, আমরা মানুষ, পৃথিবীর সর্বোন্নত জীব, একমাত্র চিন্তাশীল প্রাণী। কিন্তু আমরা ক্রমশঃ সংকীর্ণ হচ্ছি। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, ভাষা, প্রাদেশিকতা – নানা কিছুকে ভিত্তি করে আমরা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। [•প্রতিবেদককে সরাসরি মন্তব্য জানাতে পারেন +91 94746 23620 এই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে]

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।