উমাশঙ্কর নিয়োগী: শঙ্খ বণিকদের ইষ্ট দেবতা অগস্ত্য মুনি। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির সময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার কাদিলপুরের শঙ্খ বণিকেরা সাধ্যমত সাড়ম্বরে অগস্ত্য ঋষির আরাধনা করেন। প্রকৃতপক্ষে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথিতে অগস্ত্যকে অর্ঘ্য দানের মধ্যে দিয়ে। ওই দিন শঙ্খ বণিকেরা শাঁখের কোনও কাজ করেন না। পুরো বিশ্রাম পায় শঙ্খ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত যন্ত্রপাতি। কাদিলপুরে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে সংক্রান্তির পূর্ব দিন পুজো শুরু হয় সংক্রান্তির দিন ঘটা করে বড় পুজো আর পরদিন পূজান্তে বিসর্জন হয়। এতো মুনি ঋষি থাকতে কেন ঋষি অগস্ত্য এঁদের ইষ্ট দেবতা? সেই প্রসঙ্গে আসা যাবে। তার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা জেনে নেওয়া যেতে পারে।
হরপ্পা সভ্যতার আমাদের পূর্বজদের শঙ্খের ব্যবহার জানা ছিল। মাটি খুঁড়ে শাঁখ পাওয়া গিয়েছে। বেদে শঙ্খ শব্দ নেই। তবে ‘বকুর’ ও ‘গোমুখ’ শব্দ দুটো শঙ্খ শব্দের সমার্থক বলে পণ্ডিতমণ্ডলী জানিয়েছেন। গুজরাত থেকে মেঘালয়, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সর্বত্র শঙ্খ তথা শাঁখ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মাচরণে ব্যবহৃত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। পূজা অর্চনায়, যাগযজ্ঞে, দশকর্মে শঙ্খ ধ্বনিকে অতি পবিত্র মনে করা হয়। শুভ সংবাদ এবং বিপদ সংকেত দুই পাঠানো হয় শাঁখ বাজিয়ে। আগে সমরাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু, বিরতি ও শেষ হত শাঁখ বাজিয়ে। এখনও অনেক হিন্দু বাড়িতে দিনের যুদ্ধ শুরু এবং শেষ হয় শাঁখ বাজিয়ে। এতো যে দরকারি সেই শঙ্খের উৎপত্তি সম্পর্কে আগে পুরাণ কী বলে জানা যাক।
মহর্ষি কশ্যপের ঔরসে পত্নী অদিতির গর্ভে বিষ্ণু, মিত্র, অর্যমা ইত্যাদি দেবতা, দিতির গর্ভে হিরণ্যকশিপু, হিরণ্যাক্ষ দৈত্য এবং দনুর গর্ভে দানবদের জন্ম। স্বর্গ সুখ ভোগ নিয়ে বৈমাত্রেয় ভাইদের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ লেগে থাকতো। কোনবার দেবতা স্বর্গ দখল করে তো পরের বার দৈত্য তার পরে দানবের দখলে যায়। ঠিক এখনকার রাজনৈতিক দলের মতো। একবার দানবরা শঙ্খচূড় নামে তাদের এক নেতার নেতৃত্বে দেবতাদের স্বর্গ সুখ কেড়ে নিল। কাঁদতে কাঁদতে দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গেলেন। বিষ্ণুর পরামর্শে শিবের কাছে ছুটলেন তাঁরা। দেবতাদের কান্নায় শিবের মন নরম হল। ত্রিশূল নিয়ে, শিঙ্গা ডমরু বাজিয়ে যুদ্ধে গেলেন মহাদেব। শঙ্খচূড়কে পরাজিত করতে বেশ বেগ পেলেন তিনি। অবশেষে ত্রিশূল দিয়ে বধ করলেন শঙ্খচূড়কে। ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য শিব অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে শঙ্খচূড়ের হাড়গুলো গুঁড়িয়ে ছড়িয়ে দিলেন ভারত মহাসাগরের জলে। সেই হাড় থেকে জন্ম নিল শঙ্খ। শিবালয়ে পাণিশঙ্খ ব্যবহার করা হয় না। মনেহয় শিব মনে করেন, ওই বুঝি শঙ্খচূড় জল থেকে উঠে তেড়ে আসছে তাঁর দিকে। সূর্য মন্দিরে শঙ্খ ধ্বনি নিষিদ্ধ কেন কে জানে! যাকগে ওসব কথা।
চতুর্ভুজ বিষ্ণু শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী দেবতা। তাঁর শঙ্খের নাম পাঞ্চজন্য, চক্রের নাম সুদর্শন, গদার নাম কৌমোদকী। পদ্মের নাম? পদ্ম। পাঞ্চজন্য শাঁখটি বিষ্ণু উপঢৌকন পেয়েছেন বিশ্বকর্মার কাছ থেকে। এটির মালিক ছিলেন চন্দ্রবনের অধিপতি পাঞ্চজন নামে এক দানব। তাকে হত্যা করে শাঁখটি নিয়ে আসেন বিশ্বকর্মা। পাঞ্চজনের শাঁখ তাই পাঞ্চজন্য। ভগীরথ শাঁখ বাজিয়ে মর্ত্যলোকে গঙ্গা এনেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে শঙ্খের উল্লেখ আছে। অযোধ্যায় ফিরে আসার সময় ভরত রামচন্দ্রকে শাঁখ বাজিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। ব্যাসদেবের মহাভারত যুদ্ধে পাঞ্চজন্য, দেবদত্ত, অনন্তবিজয়, পৌণ্ড্র, মণিপুষ্পক ইত্যাদি শাঁখের বহুল ব্যবহার হয়েছে। মহাকবি কালিদাস তাঁর রঘুবংশ কাব্য শাঁখের উপমা ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রে এবং ধর্মাচরণে শাঁখ আছে। এখন থেকে প্রায় দুহাজার বছর আগে তামিলনাড়ুর রাজধানী ছিল ‘কোরকাই’। কোরকাই এর ভগ্নস্তূপ থেকে কেবল শাঁখ নয় শঙ্খ শিল্পের নমুনা পাওয়া গিয়েছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে লেখা দুটি তামিল কাব্য ‘Madurikkanchi’ আর ‘Silappathikaram’-এ শঙ্খের বিভিন্ন ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে।
বড়ুচণ্ডী দাস শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যে বহুবার শঙ্খ এবং শাঁখ শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিজয় গুপ্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সহ মঙ্গল কাব্যের অন্যান্য কবির কাব্যে শাঁখ বাজানোর কথা আছে। হতদরিদ্র ভিখিরি শিবের বউ পার্বতী ঠাকরুণ শাঁখা বেড়ে গিয়েছে বলে শিবের কাছে শাঁখা চেয়ে বসলেন। বললেন, ‘লজ্জায় লোকের মাঝে লুকাইয়া রই।/ হাতে নাড়া দিয়া বাড়া কথা নাহি কই।।’ রামেশ্বর চক্রবর্তীর শিব তো ট্যাঁকখালির মস্ত জমিদার। তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে, কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ভিখারীর ভার্যা হয়ে ভূষণের সাধ।/ কেন অকিঞ্চন সনে কর বিসম্বাদ।।/বাপ বটে বড় লোক বল গিয়া তারে।/জঞ্জাল ঘুচুক যাও জনকের ঘরে।।’ মা ঠাকরুণও গোঁসা করে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। দিন কতক পরেই শিবচন্দ্র শাঁখারির ছদ্মবেশে হাজির হলেন শ্বশুর বাড়ি। পার্বতী শাঁখা পরতে বসে শিবের ছোঁয়াতে বুঝলেন শাঁখারি কে। তার পর? মান অভিমান শেষ। তবে, শ্বশুর বাড়ির জামাই খাতির পেয়ে ছিলেন কিনা সে কথা চক্রবর্তী মশাই লেখেননি। আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে, রূপকথার গল্পে, কাব্য কবিতা উপন্যাসে শাঁখের ছড়াছড়ি। ছেলে বেলায় আমরা একটা ধাঁধার সম্মুখীন হতাম, ‘এখান থেকে দিলাম সাড়া, সাড়া গেল বামুন পাড়া’। উত্তর শাঁখ। এমনকি আমাদের এক ভূতিনীর নামও শাঁখচুন্নি (শাঁখ চুরি করে যে ভূতিনী হয়েছে?)। এখন আমরা অগস্ত্য ঋষি কে? এবং কেনই বা তিনি শাঁখের সাথে জুড়ে গিয়ে শাঁখারিদের ইষ্ট দেবতা হলেন সেই বিষয়ে একটু জেনে নেব।
মহামুনি অগস্ত্য ঋগ্বেদের মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি। মিত্র ও বরুণ এর দুই পিতা। পরোক্ষ ভাবে মাতা উর্বশী। কাহিনী এই রকম। শ্রীহরি নিজের ঊরু থেকে উর্বশীর জন্ম দিলেন। অসামান্য রূপসী উর্বশীকে মিত্র কামনা করলেন। বরুণও চাইলেন উর্বশীর সঙ্গ। উর্বশী মিত্রকে দেহ দিতে চাইলেন আর মন দিতে চাইলেন বরুণকে। কেউ দেহ ছাড়া মন বা মন ছাড়া দেহ নিতে চাইলেন না। মিত্র ও বরুণ অভিশাপ দিলেন, উর্বশী স্বর্গে সাধারণী হবেন আর স্বর্গ চ্যুত হয়ে পুরুরবার ভোগের সামগ্রী হবেন। কিন্তু তার আগেই তো উর্বশীকে দেখে মিত্র আর বরুণের রেতঃপাত হয়ে গিয়েছে। তারপর কী করলেন দুজনে! ‘জলস্তম্ভে ততো বীর্য্যং মিত্রেণ বরুণেন চ।/ প্রক্ষিপ্তমথ সঞ্জাতৌ দ্বাবেব মুনিসত্তমৌ।। বশিষ্ঠ অগ্রজ অগস্ত্য কনিষ্ঠ।’ ঋষি অগস্ত্যের স্ত্রী লোপামুদ্রা আর পুত্র দৃঢ়স্যু। আবার শ্রীমদ্ভাগবত মতে অগস্ত্যের পিতা পুলস্ত্য মাতা হরির্ভূর।তাঁর গায়ের রং সাদা সাহেবদের মতো, চার হাত মতান্তরে দুটো হাত, হাতে কমণ্ডলু আর অক্ষসূত্র।
কালেয় দানব কুলের অধিপতি বৃত্রাসুর। দেবরাজ ইন্দ্র দধীচির হাড়ে তৈরি বজ্র দিয়ে বৃত্রাসুরকে নিধন করলেন কিন্তু অন্যান্য কালেয় দানব তারক, কমলাক্ষ,পরাবসু, বিরোচন প্রভৃতিরা সমুদ্রের তলদেশে জলদুর্গ (সাবমেরিন?) নির্মান করে সেখানে বসবাস করতে শুরু করলেন। রাত্রি বেলায় জলদুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে দেবতাদের আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে লাগল। নেহাত অমর বলে মৃতপ্রায় হয়ে দেবতার বেঁচে রইলেন না হলে মরেই যেতেন। নারায়ণের পরামর্শে ঋষি অগস্ত্য দেবতাদের বাঁচাতে এক গণ্ডুষে সমুদ্রের সমস্ত জল খেয়ে নিলেন। অস্ত্রশস্ত্র বিশারদ অগস্ত্য মুনি কী করে জলদুর্গ (সাবমেরিন) ধ্বংস করতে হয় তা দেবতাদের বাতলে দিলেন। জলদুর্গ দেবতাদের আক্রমণে ধ্বংস হল। কালেয় দানবরা নিহত হল। অগস্ত্য সমুদ্রের জল ফিরিয়ে দিলেন। সমুদ্র পূর্বের রূপ ফিরে পেল। আর এক কাহিনী প্রহ্লাদের দুই নাতি ইল্বল ও বাতাপি। লোভী বামুনদের জব্দ করার জন্য মায়াবী ইল্বল ভাই বাতাপিকে মেষ বানিয়ে তাকে কেটে মাংস রান্না করে বামুনদের খেতে দিতেন। খাওয়ার পরেই বাতাপি বলে ডাক দিলে পেট ফেটে বাতাপি বেরিয়ে আসতেন। বামুনগুলো মরে যেত। লোপামুদ্রা ধনী বাড়ির মেয়ে। গল্প উপন্যাস সিনেমা সিরিয়ালের মত কিনা জানি না। ভালোবেসে অগস্ত্যকে বিয়ে করেছিলেন বটে কিন্তু তাঁর গয়নার লোভ ছিল। এই জন্যেই বোধহয় লোকে বলে, যে মেয়ে শাড়ি সোহাগিনি আর গয়না সোহাগিনি নয় তার মাথার ছিট আছে। লোপামুদ্রার মাথার ছিট ছিল না। তাই অগস্ত্যকে দেহ দেবার আগে গয়না চেয়ে বসলেন। পুরুষেরা সুহাগ রাতের কথা ভাবুন! সেই থেকে শুরু। অগস্ত্য কী আর করেন! ঋষি মানুষ! তিনি এত ঘোরপ্যাঁচ জানতেন না। বাধ্য হয়ে গুটিগুটি পায়ে বামুনের ছদ্ম বেশে হাজির হলেন ধনবান ইল্বলের কাছে। পূর্বের মতো মেষ কেটে মাংস রান্না হল। অগস্ত্য রাক্ষুসে বামুনের মতো একাই গোটা মেষের মাংস খেয়ে নিলেন। এরপর বাতাপিকে হাজার ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া গেল না। ইল্বল ভাইকে বাঁচানোর জন্য ব্রাহ্মণ অগস্ত্যের পায়ে পড়লেন। লোপামুদ্রার চাহিদা অনুযায়ী গয়না নিয়ে প্রায় হজম হয়ে যাওয়া বাতাপিকে উগরে দিলেন অগস্ত্য। একবার বিন্ধ্য পর্বত উঁচু হয়ে ওঠে সূর্যের পথ অবরোধ করে দাঁড়াল। সুয্যিঠাকুর কমপ্লেন করলেন দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে।বিন্ধ্য অগস্ত্য শিষ্য। দেবতাদের অনুরোধে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন বিন্ধ্য পর্বতের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন অগস্ত্য। গুরুকে দেখে প্রণাম করতে মাথা নত করল বিন্ধ্য। অগস্ত্য বললেন তিনি যতক্ষণ না ফেরেন ততক্ষণ যেন এই ভাবেই থাকে। সেই যে তিনি গেলেন আর ফিরলেন না, বিন্ধ্যের আর মাথা তোলা হল না। সূর্য স্বাভাবিক গতিতে চলতে আরম্ভ করলেন। বাঁচল প্রকৃতি আর জীবকুল। অগস্ত্য অস্ত্রশস্ত্র বিশারদ ছিলেন। রামচন্দ্রের বৈষ্ণব ধনু, অক্ষয় তূণ এবং ব্রহ্মদত্ত তরবারি অগস্ত্যের তৈরি। দ্রোণাচার্য যে ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র ব্যবহার করতেন তার প্রযুক্তিও অগস্ত্যের। শাঁখ কাটার করাত শঙ্খাসুর বধের শস্ত্র কি অগস্ত্যের? শাঁখারিদের জীবিকা অর্জন শাঁখ নির্ভর। শাঁখ সমুদ্রের এক প্রকারের শামুক বিশেষ। ডুবুরি সমুদ্রের তলদেশ থেকে শাঁখ তুলে আনে। এদের বিশ্বাস ডুবুরি অগস্ত্যের আশীর্বাদে শাঁখ দেখতে পায়। তাছাড়া প্রকৃতিকে বাঁচিয়েছেন তিনি। অন্য সবাই অগস্ত্যের উপকার বিস্মৃত হলেও তারা হননি। কৃতজ্ঞতা বশে অগস্ত্য পুজোর আয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গের শাঁখারিরা তাদের শিল্প কর্মে যে কাঁচামাল তথা শাঁখ ব্যবহার করেন তা আসে মূলত দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর সমুদ্র উপকূলবর্তী আড়ত আর শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশের মান্নান উপসাগরের কূলে অবস্থিত জাফনা জেলা শহর থেকে। তামিলনাড়ুর দক্ষিণ আর্কট জেলা, রামেশ্বর, তাঞ্জোর, মুক্তোর শহর তুতিকোরিন, ত্রিবাঙ্কুর প্রভৃতি স্থানে শাঁখের পাইকারি বাজার আছে।শাঁখের বহু প্রজাতি। তিতকৌড়ি বা তিতপুটি, জাডকি, আলাবিলা, পাটি,রামেশ্বরী, জিআরপি, ঢলা, দোয়ানি, খগা ইত্যাদি। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিতকৌড়ি আর নিকৃষ্ট আলাবিলা। শাঁখ কেটে মূলত শাঁখা হয়। বিবাহিত হিন্দু মেয়েরা সধবার চিহ্ন হিসেবে শাঁখা পরেন। এখন অবশ্য জীবিকার প্রয়োজনে এবং কেউ-কেউ নিজেকে অবিবাহিতা দেখাতে শাঁখা পরেন না। সধবার চিহ্ন এই শাঁখাতে নানা রকম নকশা করা হয়। কত তাদের নাম টালি, ইংলিশ প্যাঁচ, শিকলি বালা, পানবোট, জালফাঁস,আঙুর পাতা ইত্যাদি। এখন কেবল শাঁখা নয় আংটি, বোতাম, ব্রোচ, লকেট, ধূপদানি, পেপার ওয়েট সহ নানাবিধ গৃহসজ্জার জিনিসপত্র তৈরি হচ্ছে। চুন হচ্ছে শাঁখের বাতিল অংশ দিয়ে। এছাড়া বাজানোর শাঁখ, দেবদেবীর জল পানের জন্য পাণিশঙ্খ হিসেবে শাঁখ ব্যবহার হয়। এগুলো সবই বামাবর্ত। সাদা শাঁখ এবং দক্ষিণাবর্ত শাঁখ মহামূল্যবান। দাম কোটি টাকারও বেশি।
শাঁখারিরা এল কোথা থেকে? এদের আদি নিবাস কোথায়? এ সম্পর্কে নানা গবেষক নানা মত পোষণ করেন। তবে বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন এরা কর্নাটকের বাসিন্দা। ধনপতি সওদাগর নামে কোনও এক শঙ্খবণিক এদের পূর্বপুরুষ। বঙ্গদেশে দ্বাদশ শতকে বল্লাল সেনের আমলে বেশ কিছু শঙ্খবণিক কর্নাটক থেকে এসে ঢাকার বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কাফুর টিনেভেলির হিন্দু রাজ্য ধ্বংস করেন। টিনেভেলির অধিকাংশ শাঁখারি ঢাকার বিক্রমপুরে উঠে আসেন। মোগলরা এদের স্থায়ী বসবাসের উপযোগী ভূমি নির্দিষ্ট করেন। ঢাকা থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে শাঁখারিরা।
কাদিলপুর গ্রামে শাঁখারিদের বসবাস শুরু পাঁচশো বছর আগে। কাদিলপুর নামটি লক্ষণীয়। শাঁখ কাটার করাতকে ‘কাতি’ বলে। কাতিলপুর থেকে কাদিলপুর হয়েছে কিনা ভাষাতাত্ত্বিকেরা বলতে পারবেন। তবে আমার বিশ্বাস কাতি থেকেই কাদি এসেছে। কাদিলপুর একটি মৌজার নাম। আরবি শব্দে মৌজা অর্থে গ্রাম বোঝায়। কাদিলপুরের শাঁখারিরা দেড়শো দুশো বছর আগেও বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। ওদের পূর্ব পুরুষদের তৈরি বেশ কিছু টেরাকোটার ফলক যুক্ত পঞ্চরত্ন বিষ্ণু মন্দির তার প্রমাণ স্বরূপ আজও দণ্ডায়মান। ওরা জানান, ওদের মূর্তি গড়ে মুনি পুজো চারশো বছর ধরে চলে আসছে। এ দাবি অযৌক্তিক নয় বলেই মনে হয়। বর্তমানের কাদিলপুর আর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কাদিলপুরে শঙ্খ শিল্পের চিত্র এক নয়। বছর পঞ্চাশ আগেও কায়ক্লেশে কোনওরকম জাত ব্যবসা টিকিয়ে রেখে ছিলেন এখানকার শাঁখারিরা। সেই সময় অনেকেই অন্য বৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও এর বহু পূর্বে রাধাকান্তপুরের কৈলাশ দত্ত ঢাকার অনুকরণে এলাকার শাঁখাকে আধুনিক রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন তাতে খুব একটা অবস্থার হেরফের হয়নি।
হাওড়া জেলার বাগনান থানার একটি গ্রামের নাম বাঁটুল। এখানে প্রচুর শাঁখারির বাস। এককালে বাঁটুলের শাঁখারিরা শাঁখের ব্যবসা করে উন্নতি করেন। এদের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মন্দির অতীত কালের গৌরবের সাক্ষ্য দিতে এখনো বর্তমান। যাক ওসব কথা। এই বাঁটুল গ্রামের কামারগণ উন্নত মানের অর্ধ চন্দ্রাকৃতি হাতে চালানো শাঁখের করাত ‘কাতি’ তৈরি করতেন এবং এখনও মেশিনের শাঁখের করাত তৈরি করেন। আর বর্ধমানের দীননাথপুরে এই কাতি তৈরি হত। কাদিলপুরের শাঁখারিরা এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাঁটুল থেকে শাঁখা কাটিয়ে আনতেন। কাতি কিনে এনে টুকটাক শাঁখা কাটতেন। এখানে কেবল শিলে ঘষে পালিশ আর ফাইল দিয়ে নক্শা কাটা হত।
১৯৮০- ৮১ খ্রিস্টাব্দ। শাঁখারি বাড়ির ছেলে সুজিত দত্ত জাত ব্যবসা ছেড়ে সুপুরি ব্যবসায় নামলেন। উঠতি যুবক, পরিশ্রমী উদ্যোগী আত্মবিশ্বাসী সুজিত দত্ত। তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে সুপুরি আমদানি করতেন। নিজেই যেতেন মাদ্রাজ। ওই সময়ে একবার বেশ কিছু দিন সুজিত দত্ত নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ফিরে আসেন তুতিকোরিনের আড়ত থেকে সরাসরি শাঁখ কিনে। কাদিলপুরের শঙ্খ শিল্পে নব প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। সুজিত দত্তের পিতা ভবতারণ দত্ত বিখ্যাত মৃৎশিল্পী তাঁর ও আশুতোষ দত্ত, নিরঞ্জন দত্ত প্রমুখ শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় শাঁখা নবরূপ পেল। কাদিলপুরের শাঁখার চাহিদা বাঁকুড়ার হাটগ্রামের শাঁখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কাঁসাই নদীর এপারে কোলমিজোড়ে বিদ্যুৎ থাকলেও কাদিলপুরে ছিল না। সুজিত দত্ত কোলমিজোড়ের দুর্গা মণ্ডপে শাঁখা পালিশ করার মেশিন বসালেন। পরে নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ট্রান্সফরমার কিনে কাদিলপুরে বিদ্যুতের সংযোগ নিলেন। বসালেন শাঁখ কাটার, পালিশের মেশিন। কাদিলপুরের ম্লানমুখ শাঁখারিদের মুখে হাসি ফোটালেন সুজিত দত্ত, ভবতারণ দত্ত। পরে পরে এগিয়ে এলেন মুক্তিপদ দত্ত, ভুবনচন্দ্র দত্ত, বিষ্ণুপদ দত্ত প্রমুখেরা।
এক সময়ে বহির্ভারতের নেপাল, চীন,ভুটান, বার্মা প্রভৃতি দেশে বঙ্গের শাঁখা শাঁখ রপ্তানি হত। কাদিলপুরের শাঁখা ভারতের সর্বত্র তো বটেই নেপালেও যায়। সারা ভারতে দাসপুর ঘাটালের স্বর্ণ শিল্পী ছড়িয়ে আছেন। তারা যেখানে আছেন কাদিলপুরের শাঁখা আর শাঁখ দুই হাজির হয়েছে সেখানে। বর্তমানে শতাধিক পরিবারের প্রায় চারশো জন পুরুষ মহিলা শঙ্খ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এরা সবাই শাঁখারি নয়। অন্য জাতের মানুষও এর সাথে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কাদিলপুরের শঙ্খশিল্প আক্ষরিক অর্থেই সুজিত দত্তের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখনও বিস্তর অভাব অভিযোগ থাকলেও এদের ম্লান মুখে হাসি ফোটানোর প্রধান কারিগর সুজিত দত্ত।
দাসপুর থানার কাদিলপুর ছাড়াও রাধাকান্তপুর, বৈকুন্ঠপুর, নাড়াজোল সংলগ্ন দুবরাজপুর, বাসুদেবপুর, কোলমিজোড়, শ্রীবরাতে শাঁখারিরা বসবাস করেন। ঘাটাল মহকুমার অন্যত্রও শাঁখারিদের বসবাস আছে। কিন্তু মূর্তি করে অগস্ত্য পুজো তথা মুনি পুজো হয় কাদিলপুর আর দুবরাজপুরে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার যোগীবেড়ে মূর্তিতে পুজো হয়। আর কোথাও হয় কিনা জানা নেই। অনেক শাঁখারি ঘটে মুনি পুজো করেন। মূর্তি করে অগস্ত্য পুজো খুবই বিরল। বর্তমানে শাঁখারিদের বিশ্বকর্মা পুজোর প্রবণতা বাড়ছে। পুরোহিত দর্পণে অগস্ত্যের ধ্যান বা পুজো পদ্ধতি নেই। এর থেকে বোঝা যায় এটি কত অপ্রচলিত। ১৪২৭ সালের পাঁজিতে ভাদ্র মাসের ১৬ তারিখ আর ২৯ তারিখে অগস্ত্যকে অর্ঘ্য দানের দিন। যে মন্ত্র বলে অর্ঘ্য দিতে হয়: ‘কাশপুষ্প প্রতিকাশ অগ্নিমারুত সম্ভব।/ মিত্রাবরুণয়োঃপুত্র কুম্ভযোনে নমোস্তুতে তু।।’ প্রণাম মন্ত্র: ‘আতাপির্ভক্ষিতো যেন বাতাপিশ্চ মহাসুরঃ।/সমুদ্রঃ শোষিতো যেন স মেহগস্ত্যঃ প্রসীদ তু।।’ কাদিলপুরে পূর্বে একচালে ঋষি অগস্ত্য তাঁর পত্নী লোপামুদ্রা আর পরি দাসী থাকত। দাড়িগোঁফ ও জটাজালযুক্ত দুই হাত বিশিষ্ট সাদা রঙের মুনি। হাতে কমণ্ডলু, জপমালা। ১৯৬০ -৬২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভবতারণ দত্তের আধুনিকায়ন করেন। পরি দাসী বাদ দিয়ে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে মেড়ের সঙ্গে যুক্ত করলেন। মুনির বেশও পাল্টেছে। আগেই বলা হয়েছে শাস্ত্রীয় মতে অগস্ত্য শ্মশ্রুমণ্ডিত, চতুর্ভুজ, শ্বেত বর্ণ, কমণ্ডলু ও অক্ষসূত্রধারী।
পুজো শেষে তিনবার শাঁখ বাজানোর নিয়ম। তিনবার শঙ্খ ধ্বনি করে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে আহ্বান জানানো হয়। এরপর যত বাজবে অন্যান্য দেবদেবী, যক্ষ, রক্ষ,দানব দৈত্য সব এসে হাজির হবেন। খুব সাবধান! বিয়ে বাড়িতে অযথা প্যাঁ প্যাঁ করে শাঁখ বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দিয়ে নব দম্পতির ভবিষ্যত দাম্পত্যজীবনকে সংঘাতের খাদের কিনারায় আর দাঁড় করিয়ে দেবেন না! একটি পৌরাণিক কাহিনী শুনিয়ে শেষ করব।
শঙ্খাসুর তার স্ত্রী তুলসী। যেমনটি সব হয়েছে আগে তেমনি। তুলসী বিষ্ণু ভক্ত আর অত্যাচারি শঙ্খাসুর বিষ্ণু বিদ্বেষী। বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে শঙ্খাসুরকে বধ করলেন। তুলসী অমর দাম্পত্যজীবন কামনায় তপস্যা করে শ্রীবিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করে অমর দাম্পত্যজীবন লাভ করলেন। তুলসী তুলসী গাছ হয়ে জন্মালেন আর শঙ্খাসুর হল শাঁখ। তাই তুলসী গাছের কাছে শাঁখ বাজানো হয়। স্বামী কথা বলে স্ত্রী চুপ করে শোনে। আর বর্তমানে!! বিষ্ণু পুজোর প্রধান উপকরণ তুলসী আর শঙ্খ বাদন। কাদিলপুরের শঙ্খ শিল্পের জয় হোক। অগস্ত্য মুনি আর মুনি পত্নী লোপামুদ্রাকে প্রণাম।
আমি বলেছি আপনারাও কাদিলপুরের বিষ্ণু দত্ত, মুক্তিপদ দত্ত, ভুবনচন্দ্র দত্তদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
•লেখক পরিচিতি: উমাশঙ্কর নিয়োগীর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চাঁদপুর গ্রামে। তিনি গবেষণা ধর্মী ও সাহিত্য বিষয়ক প্রতিবেদন লিখতে বেশি পছন্দ করেন। এক সময় তিনি দাসপুর-১ ব্লকের নন্দনপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন তিনি অবসরগ্রহণ করেছেন। তাঁর মোবাইল নম্বর: ৯৪৭৪৪৪৯০৯৯/৮১১৬০৬৮৩২২
ঘাটাল মহকুমার সমস্ত খবর পেতে আমাদের MyGhatal মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করুন [লিঙ্ক 👆] এবং ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন[লিঙ্ক 👆]।