ঘাটাল মহকুমা সহ সারা রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে নানান অভিযোগ উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। এদিকে ওই কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে নানা রকম সমস্যা ও জটিলতার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেই সমস্ত সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি কলকাতায় সাংবাদিকদের সামনে ডাঃ কুণাল সরকার যা বলেছিলেন পুরো বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র কর্মকার
♦স্বাস্থ্যসাথীর মেন [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]সমস্যাটা কী? মেন সমস্যা হল, রাজনৈতিক কারণে হোক, আন্তরিক কারণে হোক আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে স্বাস্থ্যসাথীকে আমাদের সমস্ত জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল। এটা একটা বিরাট পদক্ষেপ। ইট ইজ আ রেভোলিউশন ইন হেল্থ কেয়ার। অসুবিধেটা কোথায়? অসুবিধে হল, সরকারকে যদি সেটা ফান্ড করতে হয়। আমার আপনার সামনে রয়েছে এক কিলো চাল, সেই এক কিলো চালের ভাত ফুটিয়েছি আমি, সেই ভাত খেতে একশ লোক এসে হাজির হয়ে গেছে। এবার আমি বেশি চাল কিনে বেশি ভাত করব, না যে লোকগুলো খাবার জন্য লাইন দিয়ে বসে আছে তাদের অন্য
ব্যবস্থা করব সেটা আমাদের ভেবে ফেলতে হবে। এই সমস্যাগুলো না হওয়াটা অস্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের যেগুলো এখন ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে করতে হবে। স্বাস্থ্যসাথী কারা নিচ্ছে? প্রাইভেট হসপিটালরা নিচ্ছে। তাহলে প্রাইভেট হসপিটালকে তার দিন চালিয়ে, তার লোকজনের মাইনে দিয়ে, ওষুধের খরচা দিয়ে মোটামুটি একটা খরচায় বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করতে হয়। কারও হাড়গোড় ভেঙে যেতে পারে, কারও হার্টের প্রবলেম হতে পারে, কারও জ্বরজালা হতে পারে, কারও সেরিব্রাল স্টোক হতে পারে। মানুষের অসুখ তো একটা ছকে হয় না? হেল্থ কেয়ারে কস্টিংটা একটু জটিল ব্যাপার। এই ব্যাপারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চিন্তা করে একটা রূপরেখা করতে আমাদের সময় লাগবে। ধীরে ধীরে এটা আসবে। আমরা সরকারকে বারবার যেটা বলার চেষ্টা করছি, এখন এই ইকোনমিক অ্যানালিসিস, কস্টিং ইত্যাদি করার অনেক
রকম ব্যাপার আছে। আপনারা ঠাণ্ডা মাথায় সেইরকম একটা কস্টিং করুন এবং দেখে নিন। এই যে কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী খুব মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। উনি বললেন, যে এফআইআর করুন, হসপিটালদের বিরুদ্ধে পুলিশে কমপ্লেন করুন, আদৌ উনি কথাটা ঠিক বলেননি। কেন বলেননি? ওনার মধ্যে হয়তো একটা ফ্রাসট্রেশন আছে, ওনার এটা অত্যন্ত একটা মনের স্কিম। উনি চাইছেন এটাতে যাতে কোনও রিফিউজাল না হয়, কিন্তু আমি তো চাইলেই হবে না। আজকে যেকোনও নার্সিংহোম, মাঝামাঝি প্রাইভেট জায়গাতে যদি ক্রিটিক্যাল কেয়ারে একটা মানুষ একদিন ভর্তি থাকেন, ইন্ট্রাভেনাস, ওষুধপত্র করে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা তার খরচ হবে। এবার আমি যদি তাকে বলে দিই যে, আমি সরকার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি তার বাইরে এক টাকাও নেওয়া যাবে না, তাহলে কী করে হবে? আমার ধমকে তো কাজ হবে না! ধমকে কী লোকের মাইনে দিতে পারবেন? ধমকে কী ওষুধের বিলটা দিতে পারবেন? তাহলে ওই নার্সিংহোমটার যদি তিন মাস মাইনে বন্ধ থাকে, যখন তার কর্মচারিগুলো এসে হুজ্জুতি করবেন বাইরে তখন সে ধাক্কাটা কে নেবে? তাহলে এই ঝামেলাগুলো নিয়ে বারবার বলছি। আমাদেরও কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। ঝামেলাগুলো না আসাটা অস্বাভাবিক। ইট উইল কাম। আমরা একটা বিরাট লাফ মেরেছি। আমাদের স্বাস্থ্যসাথী ২০১৬ তে যখন শুরু হল তখন মেরে কেটে চার-পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যার কাছে পৌঁছত। তারপরে প্রি-ইলেকশন, ২০২১ এ ইলেকশন হল, ২০২০-র নভেম্বর মাস নাগাদ হঠাৎ আমি গেটটা খুলে দিলাম। এবং এই যে একটা বিপুল জনসংখ্যাকে আমি দিতে চাই, এই চাওয়াটাই একটা বিরাট ব্যাপার! আমরা কোথাও আটকাবো, কোথাও ঠোক্কর খাব, আবার টেবিলে বসতে হবে, আবার হিসেব নিকেশ দেখতে হবে, আবার দেখতে হবে ফান্ডিংটা কোথা থেকে আসতে পারে। আমাদের এই কষ্টগুলো সহ্য করে, সরকারকেও বুঝতে হবে যে, হ্যাঁ এই হিসেব নিকেশগুলো ঠিক হয়নি। আর এখন সরকারের সবচেয়ে বড় অসুবিধে হচ্ছে যে সরকারের কেত্তনের গান গাইবার থেকে দোহারকীর দল ভারী হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যভবন, আমলা, মন্ত্রী, হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী রয়েছেন যাঁরা, তাঁরা যদি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বলতে শুরু করেন, ‘সব ঠিক আছে’, তাহলে মুখ্যমন্ত্রীদের মতো মানুষ যাঁদের কাছে একদিনে হাজারটা সমস্যা তাঁরাও মনে করছেন, সব ঠিক আছে। যেটা ব্যক্তিগত ভাবে আমার সন্দেহ, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আদৌ এই সমস্যাগুলো কী ঠিকভাবে পৌঁছায়? উল্টে আমরা তাঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছি— না দেখুন, এই দেখুন, রোগীকে অ্যাডমিশন নিচ্ছে না। কেন নিচ্ছে না? হাসপাতাল বদমায়েশি করছে, নার্সিংহোম বদমায়েশি করছে। আরে বাবা এটা ভালো ছেলে খারাপ ছেলের ব্যাপার নয়। এটা শাশুড়ি-বৌয়ের সিরিয়াল হচ্ছে না; আপনি দুমিনিট টাইম দিন বা একটা কমিটি গঠন করুন। করে দেখুন ঝামেলাগুলো কোথায়? সাতদিন–দশদিন সময় দিন। সলিউশনগুলো বেরিয়ে আসবে।
সোজা বাংলায় বলতে গেলে আমার মনে হয়, আমাদের স্বাস্থ্যদপ্তরের যে কমপিটেন্ট, যে ক্যাপাসিটি, যে অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে আছে স্বাস্থ্য দপ্তরের স্বাস্থ্যসাথী ইমপ্লিমেন্ট করার কমপিটেন্টস নেই। কেন নেই? তারমধ্যে সমস্ত রিটায়ার্ড করা সিনিয়ার সিনিয়ার ডাক্তাররা গিয়ে তাঁরা নবরত্ন সভা আলো করে বসেছেন। কিন্তু তাদের হেল্থকেয়ার কস্টিং, হেল্থকেয়ার ইকোনমিক্স, হেল্থকেয়ার ফাইন্যান্স—কীকরে আমি দিনে একশ টাকা রোজগার হলে কতটাকা বাজার করব, ক’টাকা বাঁচাব, ক’টাকা খরচা হবে; হেল্থকেয়ার ইকোনমিক্সে একটা প্রগাঢ় অনভিজ্ঞতা বর্তমান স্বাস্থ্যদপ্তরে রয়েছে এবং তাঁদের মধ্যে সেই কমপিটেন্টস-এর অভাবটা আছে বলে তাঁরা একসময় জো হুজুর জো হুজুর করছেন আর না হলে হয়ে যাচ্ছে এ ভালো ও খারাপ, এ ভিলেন। আরে ভাই এটা কী আপনি আশির দশকের হিন্দি সিনেমা দেখছেন এখানে? যে একটা হিরো, ভিলেন, আইটেম নাম্বার দিয়ে এটাকে শেষ করে দেবেন। আপনাকে জিনিসটার গভীরে ঢুকতে হবে, জিনিসটার ডিটেলে ঢুকতে হবে। আর বারবার অনুরোধ করব, দেখুন এই ঝামেলাগুলো আসবে, ঝামেলাগুলো আসাটা প্রত্যাশিত। কিন্তু তা বলে মুখ্যমন্ত্রীর মত একজন দায়িত্বশীল লোক বলছেন যে, পুলিশের কাছে গিয়ে এফআইআর করো। আপনি কী চাইছেন? আপনি চাইছেন যে ৬৫ থেকে ৭৫– এর সেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অরাজকতা শুরু হোক পশ্চিমবঙ্গের বুকে! মেদিনীপুরে দেখেন কিনা জানি না, হাওড়ায় হেঁটে দেখবেন, আসানসোলে হেঁটে দেখবেন, যাদবপুরে হেঁটে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গে যত না ইন্ডাস্ট্রি আছে তার থেকে ইন্ডাস্ট্রির কঙ্কাল বেশি আছে। সেগুলো তৈরি হয়েছিল কী করে? যে কোম্পানির রেভিনিউ নেই, যে কোম্পানির লাভ নেই তার ঘাড়ে চেপে গলা টিপে বলছিলেন যে আমাকে কুড়ি পার্সেন্ট বোনাস দাও। আজকে সেই মরচে ধরা যন্ত্রগুলো শুকোচ্ছে। আশা করি আপনি সেই তাণ্ডব নৃত্য হেল্থ কেয়ারে দেখতে চান না।