দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়: চন্দ্রকোণা-১ ব্লকের নির্ভয়াপুর গ্রামের দাস পাড়ার মানুষ আতঙ্কিত কারণ আট বছর ছ’মাসের মেয়ে রমা দাস কে নাকি এক অজানা প্রাণী টেনে নিয়ে গিয়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে শিলাবতী নদীতে স্নানের সময়। প্রাণীটি সাদা,লম্বা হাত,লম্বা চুল, লাল চোখ, মুড়ো কান আর নীল পা! ফলে ঘটনার দু-তিনদিন পর বেরিয়েই পড়লাম সত্যানুসন্ধানে। সঙ্গী তাপস কর্মকার ও অয়ন সাউ।[•এই খবর সম্পর্কিত ভিডিওটি দেখতে চাইলে ▶এখানে ক্লিক করতে পারেন।]
ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। ভিকটিম রমা দাসের জবানবন্দি রেকর্ড করলাম। প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করা আরও দু’জন মহিলা সমেত অনেক মানুষের বক্তব্য রেকর্ড হল। রমার আঁচড় খাওয়া পেটের ছবিও নিলাম। খামারবেড়্যার মাল পাড়ার কিছু মানুষও এই প্রাণীটিকে দেখেছেন শুনে সেখানেও গেলাম। কিন্তু একজন মাত্র প্রত্যক্ষদর্শী পেলাম যিনি দাস পাড়ার ঠিক উল্টো কথাই শোনালেন।পরে জবানবন্দি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলেছেন। যেমন, একজন প্রত্যক্ষদর্শী দেখলাম মূল ঘটনা ঘটার আগে থেকেই রহস্যময় কারণে আতঙ্কিত! আবার,এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, রমার পেটে চারটি নখের লাল আঁচড়ের দাগ ছিল। কিন্তু অন্য একজন বললেন চারটে নয়, তিনটে নখের চেরা দাগ ছিলো। সত্য কখনও কি দু’রকমের হতে পারে? অথচ ঘটনার একদিন পরও জনৈক সাংবাদিক সেই দাগ দেখতে পাননি,আর আমরাও পেলাম না। কেন? যদিও দাগ থাকলেই প্রমাণ হয় না যে সেটা ওই রহস্যময় প্রাণীরই নখে চেরা দাগ। কারণ রমাকে টেনে তোলা মেয়ে দুটির নখে বা নদীতে অন্য কিছুতে লেগে চিরে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে একদিন পরেও কেন কোনও নখে চেরার দাগই পাওয়া গেল না? আবার রমা একবার বলে প্রাণীটা তাকে একসময় ছেড়ে দেয়। অথচ পরে আবার বলে দুজন মেয়ে টেনে তাকে প্রাণীটির হাত থেকে ছাড়ায়। আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতেই এসব কিছু বলছি। অবাক হবার আরও আছে। একজন বলে ওঠে প্রাণীটি রমাকে ধরার পর ওর মুখ দিয়ে রা বেরোয়নি। অথচ অন্য একজন বলে ওঠে রমা তখন কাঁদছিলো। এত অসংলগ্নতা কেন? এদিকে,প্রত্যক্ষদর্শী মৌসুমী দাস দাবি করেন, সাদা হাতের মতো কিছু একটা নাকি তার হাতের ওপর দিয়ে লাফ দেয় যখন তিনি নদীতে ছিলেন অর্থাৎ প্রাণীটা পুরো ওপরে উঠেছে। অথচ সেই তিনিই পরে বলে বসলেন প্রাণীটা পুরো উঠেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরাই যদি বিভিন্নরকম কথা বলেন, সত্য উৎঘাটিত হবে কীভাবে!
এদিকে সাংবাদিকের কাছে একজন দাবি জানালেন যে চার-পাঁচ জনের সঙ্গে নাকি এই ধরনের ঘটনা ঘটে। অথচ আমরা গিয়ে দুজনের বেশি খুঁজেই পেলাম না। কেন? আবার খামারগেড়্যা মালপাড়ার বাসিন্দা জনৈক মহিলা বলে বসলেন কোনও হাতটাত নয়, প্রাণীটিকে মানুষের মাথার মতো দেখতে,যার চুল লাল রঙের। ভাবুন অবস্থা!
এখন প্রশ্ন, প্রকৃত কী ঘটে ছিলো? আমাদের বিশ্লেষণে এখানে রহস্যময় প্রাণীটি বি-শা-ল আকৃতির এক বারখোল(বিশাল কচ্ছপ), অবশ্য পুরো ব্যাপারটা যদি না কোনও ইলিউশন(ভ্রম)হয়। কারণ ৪০-৫০ কেজি বা তার বেশি ওজনের বারখোলের হাতগুলি(পাগুলি)সাদা ও মানুষের হাতের মতোই লম্বা। বিশাল মুখ বের করতে পারে এরা। আর কামড়ে ধরাতো এদের পক্ষে কঠিন কিছু নয়, বিশেষ করে রমার মতো একটি বাচ্চা মেয়েকে খুব সহজেই কামড়ে ধরতে পারে, মুখ বা পাগুলি দিয়ে টানতে পারে সর্বশক্তি দিয়ে। যার ফলে মেয়েটি হাবুডুবু খেতেই পারে। আর প্রাণীটি ভেসে থাকলে, ভেবে দেখুন,ওদের খোলকটা মানুষের মাথার মতোই দেখতে লাগতে বাধ্য। তাতে যদি নদীর পাড়ের লাল মাটি লেগে যায়,তাকে লাল চুল বলে ভ্রম হওয়াটাও কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে শুধুই একটা হাত লাফাচ্ছে কারো মনে হলো কেন? কেনই বা বাচ্চাটির মনে হলো প্রাণীটির লাল চোখ, মুড়া কান আর নীল পা? কেনই বা এই অলৌকিকতার মোড়ক? এর একটাই উত্তর যার বাংলা করলে দাঁড়ায় এর কারণ দর্শনুভূতির ভ্রম ও স্পর্শানুভূতির ভ্রম,যদি না এক্ষেত্রে প্রাণীটা বারখোল হয়,কারণ মনে রাখতে হবে ওই দিন সন্ধ্যায় ভরের মধ্যে মেয়েটি দাবি করে কাজটি একটি ভুতের।
আর বাকি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে? তাহলে এখানে একটা কঠিন কথা বলতেই হয়, এটা যদি না তাদের দর্শানুভূতির ভ্রম হয়,তবে তাদের সমস্ত দাবিগুলিই মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য ও সমাজে বিশেষ গুরুত্ব পাবার জন্য। আর এটা বিশেষ এক ধরনের মানসিকতা। আসলে পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কখনও কিছু ছিলনা। আজও নেই। •প্রতিবেদক দ্য ফ্রি থিংকিং হিউম্যানিস্টস,ঘাটাল শাখার সম্পাদক। মো:+91 89277 93600
ঘাটাল মহকুমার সমস্ত খবর পেতে আমাদের MyGhatal মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করুন [লিঙ্ক 👆] এবং ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন[লিঙ্ক 👆]।