দেবাশিস কুইল্যা: বাঙালির জাতি সত্বার প্রথম পরিচয়ে জড়িয়ে আছে বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ ও হালখাতা। পয়লা বৈশাখে নববর্ষ ও তার সাথে জdড়িয়ে থাকা হালখাতা সময়ের নিরিখে খুব প্রাচীন নয়। দেশে মোগল যুগ শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অগ্রহায়ণ ছিল বৎসরের প্রথম মাস। অগ্র অর্থাৎ আগে বা প্রথম, হায়ণ বা আয়ন হল সূর্যের উত্তরায়ণ শুরুর সময় কাল। এই নিরিখে অগ্রহায়ণ মাসটি ছিল বছরের প্রথম মাস। এবং এই সময়ই অধিকাংশ কর আদায় করতেন সামন্ত জমিদাররা। কৃষি নির্ভর মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় কতগুলি অর্থনৈতিক বিষয় ও পদ্ধতি জড়িয়ে আছে, যা তখন থেকে এখন অবধি বিবর্তিত হয়ে এসেছে। কৃষির পরিবর্তে ব্যবসা বাণিজ্যই তার প্রধান উপলক্ষ্য হয়েছে। তফাতমাত্র এইটুকুই। পয়লা বৈশাখে হালখাতা মোগল আমলের রাজ্য শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষি অর্থনীতিই ছিল তার মূল ভিত্তি।
মোগল সম্রাট আকবরের আমলে সরকারি খাজনা- তহশিল ইত্যাদির হিসেব করা হত চন্দ্রবর্ষ অনুসারে বা হিজরির দিন, সন, তারিখ অনুযায়ী। ফসলই যেহেতু ছিল রাজস্ব আদায়ের প্রধান মাধ্যম। আকবর হিজরি মাস ধরে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। কারণ, হিজরি মাস হল ফাল্গুন চৈত্রের সময়কাল আর এই সময় ভারত বর্ষের অধিকাংশ ফসল উঠার সময়। ফসল ওঠার সময় কালকে চাষীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের উপযুক্ত বলে মনে করলেন। হিজরি মাস অনুসারে রাজস্ব আদায়ে দেখা দিল অন্য এক সমস্যা। হিজরি চন্দ্রাগতির ওপর নির্ভরশীল বলে তার দিন সংখ্যা, সূর্যের আহ্ণিক ও বার্ষিক গতির সময় অনুসারে সার্বজনীভাবে গৃহীত ৩৬৫ দিনে বছরে ১১ দিন কম হল। এরফলে রাজস্ব আদায়ের হিসেব পত্রে প্রতিবছর ব্যপকভাবে প্রচলিত বঙ্গাব্দের দিনের হিসেবের সঙ্গে গরমিল দেখা দিল। এই অসুবিধা দূর করার জন্য আকবর অবশেষে বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ তারিখকে খাজনা আদায়ের জন্য নতুন খাতা খোলার দিনরূপে ধার্য করলেন। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মোগল আমলে চালু হওয়া প্রথাটি সব ধরনের ব্যবসায়িক হিসেব নিকেশের ক্ষেত্রে প্রচলিত হয়ে গেছে।
নতুন হিসেবের খাতা বা হালখাতা শুরু হল হিজরির পরিবর্তে পয়লা বৈশাখে। সেই আকবরের শাসন কালের সময় থেকেই রাজস্ব আদায়ের নির্দিষ্ট তারিখ হিসেবে সূচনা করা হল। এই ভাবেই জমিদারতন্ত্রী অর্থনীতিতে আখ্যায়িত করা হল পূণ্যাহ বা পূণ্যদিন বলে। পূণ্যদিন বা পূণ্যাহ আখ্যায়িত করার সাথে সাথে বাঙালির সমাজ ও মানসিকতায় পরিবর্তনের সূচনা হল। তার সাথেই সূচনা হল পার্বণ হিসেবে পালনের। দোকানে দোকানে গণেশ পুজো, বাড়িতে বাড়িতে পুজো- আচ্চা, বিভিন্ন সামাজিক ব্রত পালন, জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য আগল দেওয়া, বাড়িতে বাড়িতে গৃহদেবতার পুজো আয়োজনের ব্যবস্থা।
পয়লা বৈশাখে বা বাংলা নববর্ষে গণেশ পুজোর উৎস অবশ্য মধ্যযুগে নয়। প্রাচীন যুগ থেকেই বিবর্তিত প্রথা। সিদ্ধিদাতা গণেশ ধ্রুপদি ভারতীয় দেবদেবীর মধ্যে একমাত্র পশু-মানবের সমন্বিত মূর্তি। সামাজিক দ্বন্দ্বের ও সমন্বয়ের গতিচক্রে পশু ও মানুষের সংমিশ্রনে মূর্তিটি গড়ে উঠল। এভাবনার মূলে আছে বাঙালির কৃষি ব্যবস্থা ও দেবতা নির্ভর মানুষের বিশ্বাস। অর্থাৎ কৃষি ও কৃষির সাথে যুক্ত মানুষ নানান কারণে প্রকৃতির উপরে নির্ভর ছিল। প্রথমত মানুষের মেধা ও বুদ্ধির ফলেই সাফল্য লাভ করেছে আর কৃষিক্ষেত্রে অধিক পরিশ্রমের প্রতীক হল পশু মূর্তি। এই দুইয়ের মিলিত শক্তিই কৃষিক্ষেত্রে অধিক ফসল ফলনের মূল সূত্র। এই ভাবনা থেকেই বৈশাখে গণেশ পুজোর আয়োজন বলে বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন। অন্যদিকে গনেশ ঠাকুরের অপর নাম সিদ্ধিদাতা আর বুদ্ধির প্রতীক সে কারনেই বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পয়লা বৈশাখ সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো দিয়েই হালখাতা বা নতুন খাতা শুরু করেন ব্যবসায়ীগণ। এইসব কারণ ও বাঙালির ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে স্মরণাতীত কাল হতে সঞ্চিত হওয়ায় লৌকিক সংস্কার রূপান্তরিত বা পরিশীলিতভাবে চলে আসছে। মধ্যযুগের সময়ে ব্যবসা বাণিজ্য রাজস্ব ইত্যাদি নির্ভর সমাজের প্রয়োজনে সৃ্ষ্ট হালখাতা বিষয়টিও ঢুকে পড়ল বিবর্তনের পথ ধরে।
পয়লা বৈশাখ গণেশ পুজো এবং আনুসঙ্গিক উৎসব, যেমন বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, বাস্তু অনুষ্ঠান প্রভৃতি উৎসব পালনের বিবিধ সংস্কার সমাবৃত হয়েছে। তারসাথে যোগ হয়েছে বাঙালির বাঙালিয়ানা পালনের অঙ্গ হিসাবে পরস্পরের মিষ্টিমুখ করানো, পঞ্চ শাকের সাথে পঞ্চ ব্যাঞ্জন রান্না ও পরস্পরের বাড়িতে নিমন্ত্রন ও নিমন্ত্রন রক্ষার অনুষ্ঠান। এই সবকিছুর মিলনেই বাঙালির নববর্ষ যথার্থই একটি প্রধান লোক উৎসব রূপে গড়ে উঠেছে। সর্বোপরি পয়লা বৈশাখ বাঙালির নিজস্ব সত্বার এক ঐতিহ্যময় অনুষ্ঠান।