‘ঘাটাল মহকুমার ইট শিল্প’ —সৈয়দ সাব্বির আহমেদ

ঘাটাল মহকুমার ইট শিল্প
সৈয়দ সাব্বির আহমেদ[প্রতিবেদক দাসপুরের একটি ইট ভাটার মালিক]•সবার সব কাজে পারদর্শিতা থাকে না। যে, যে কাজে অভ্যস্ত সে সেই কাজেই তার দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারে। ঠিক তেমন করেই আমি ইটভাটার মালিক বলে আমি হাজার হাজার ইট সরবরাহ করে দিতে পারি সময়ে। কিন্তু দেড় পাতা লিখতে বললেই তাে [‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন] সমূহ বিপদ এসে জোড়াে হয় মাথায়। কী করে লিখি বলুন দেখি।
প্রকৃত অর্থে মানুষ যেদিন আগুন আবিষ্কার করেছিল সেই দিনই সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল। সেদিনের মানুষ জানে না, মানুষের সভ্যতা কতদূর এগােতে পারে। কিন্তু হাজার

হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ বছর পেরিয়ে আজ বুঝতে পারি সেদিনের আগুন আজ কতভাবে মানুষের সভ্যতাকে বিকশিত করেছে।
ঘাটাল বিদ্যাসাগর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. রামরঞ্জন রায় বলেছিলেন, ইট শিল্প নিয়ে আমাকে লিখতে হবে। কিন্তু সে কথা, কোথা থেকেই বা শুরু করি। যদি ঘাটাল মহকুমার কথাই বলা হয়, তবে এই মহকুমা সৃষ্টি হওয়ায় অনেক আগে থেকেই তাে পুরানাে প্রাসাদ পাকা বাড়ি তাে ছিলই। অধুনা চন্দ্রকোণা টাউনের পাকা বাড়িগুলাে তাে তারই প্রমাণ যে, এখানের জনবসতিতে ইটের ব্যবহার ছিল। বদার রাজা শােভা সিংহ রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সেই রাজবাড়িতেও ইটের ব্যবহার ছিল। তাও তাে তাঁর

মৃত্যু হয়েছে ইংরেজি ১৬৯৬ সালে।
দাসপুর থানার নিমতলা গ্রামে কৃষ্ণমােহন গুঁই তাে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তারও আগে ছিল হেমন্ত সিংহের রাজধানী হেমন্ত নগর। প্রশ্ন, তখন তাহলে যে ইট ব্যবহার হােত তা কেমন করে এল? কোথা থেকেই বা ঘাটাল নামক জায়াগায় ইটের নির্মাণ কেমন করে হ’ত!
সুদূর অতীতে ঘাটাল মহকুমায় আধুনিক ভাটার চল ছিল না। কিন্তু ইটের ব্যবহার কমবেশি সর্বত্র ছিল। তাহলে ইট আসতাে কোথা থেকে কিংবা কিভাবেই বা ইট তৈরি হ’ত? যতদূর জানা যায়, সে সময় ইটের পাঁজা করে ইট পােড়ানাে হ’ত। সেই পােড়া ইটেই সে সময় বাড়ি নির্মাণ হত। পাঁজা করে ইট পােড়ানাের চল পাড়ায় পাড়ায় ছিল। কাৰ্যত ঘাটাল মহকুমায় বাণিজ্যিকভাবে ইট তৈরি শুরু হয় ১৯৬০ সাল নাগাদ। গােকুলানন্দ পড়িয়া ইট ভাটা করেছিলেন। ঘাটালের শিলাবতী নদীর ধারে ছিল সেই ভাটা। সেই ভাটায় হাজার হাজার ইট তৈরি হ’ত। নদীপথে, গরুর গাড়িতে সেই ইট চলে যেতাে গ্রামান্তরে। তৈরি হত পাকা বাড়ি। | একথা ঠিক, ঘাটাল মহকুমায় ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মাটির বাড়িই ছিল প্রধান বাড়ি। ধনী লােক জমিদার শ্রেণি কিংবা সম্পন্ন গৃহস্থ ছাড়া পাকাবাড়ি করবার মুরােদ’কারও হ’ত না। পাকা বাড়ি তাে জমিদার, ধনবান ব্যক্তিদের হিম্মতের নিদর্শন, যেটা সাধারণ মানুষ করতে পারত না।
১৯৬৭ সাল নাগাদ এর আগে পরে আরও দু’টি ভাটা তৈরি হয়। একটি খাটবাড়ই মৌজায় আমার বাবা সৈয়দ হারুন অল রসিদের  অন্যটি বেলতলায় অজিতকুমার পােড়ের। প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি ভাটার ইট দিয়েই ঘাটাল দাসপুর চন্দ্রকোণায় গৃহ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ হতে থাকে।
কাৰ্য্ত ১৯৭৮ সালে ১৪সেপ্টেম্বর এবং ওই সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এবং ১৯৮৪-র বিধ্বস্ত বন্যায় ঘাটাল-দাসপুর মূলত চেতুয়া সার্কিট-এর গােটা গ্রাম এবং ঘাটালের মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। সে পর্যন্ত গ্রামে মন্দির মসজিদ নির্মাণ হলেও পাকা বাড়ির প্রবণতা কম ছিল। প্রায় ৯৯ শতাংশ মাটির বাড়ি চুরমার হয়ে যাওয়ায় ঘাটাল মহকুমার সাধারণ মানুষের মধ্যে ইটের বাড়ি তৈরির প্রবণতা কেবল শুরু হল নয় প্রবণতা বেড়ে গেল। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় ঘাটাল দাসপুরে বন্যার জমা জলে চাষবাস বছরের পর বছর ধান সমস্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে পালাতে লাগলেন কাজের অন্বেষণে। দাসপুরের একটা বড় অংশ যেমন আনাজ ও অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কলকাতা ও তার শহরগুলিতে ভীড় জমালেন, তেমনি সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ সােনার কাজে ছড়িয়ে পড়লেন গােটা ভারতবর্ষ সহ বহির্বিশ্বে। তবে এই গ্রাম ছেড়ে মানুষ যে একেবারে চলে গেল তা নয়। কয়েক বছরের প্রাথমিক স্কুলের পাঠ ত্যাগ করেই কলকাতা, বােম্বাই, দিল্লি, মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি বড় বড় শহরে সােনার কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন অনেকেই। এখন এই সব বড় শহরে নয়, ছােট ছােট মহকুমা শহরেও কাজে লেগে গেলেন ঘাটাল-দাসপুরের ছেলেরা। একথা আজ হলফ করে বলতে পারি ভারতবর্ষে এমন কোনও ছােট বড় শহর নেই, যেখানে ঘাটাল দাসপুরের কোন ছেলে সােনার কাজে নেই। একটা হিসেবে জানা যায়, করােনার প্রথম ঢেউয়ে পরিযায়ী শ্রমিক (সােনার ছেলেরা) প্রায় ছ’হাজার সংখ্যক বাড়ি ফিরেছিল। এটা নেহাৎই সময়ের বিচারে অনেক কম।
এই বিপুল সংখ্যক ছেলেরা আত্মনির্ভর হওয়ার ফলে গােটা আশীও নব্বইয়ের দশকে ইটের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন এই তিনটে ভাটার পক্ষে ইট জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। খুব স্বাভাবিক কারণেই ঘাটালে ইটের বিক্রি বেড়ে যায়। পাঁজার ইট ও ভাটার ইটের গুণগত মানের পার্থক্য বুঝেই ভাটার ইটের চাহিদা এত বাড়ল যে মােট ১২ (বারাে) টি ভাটা ধীরে ধীরে তৈরি হল। এই সমস্ত ভাটায় ওই সময় প্রায় দেড় কোটি ইট তৈরি হত।। | ইটের চাহিদা ও ইটের দাম বৃদ্ধির ফলে কেবল মহকুমার উৎপাদন নয়, নরঘাট, গাদিয়াড়া, কোলাঘাট, মেদিনীপুর, বর্ধমান থেকেও ইটের জোগান বৃদ্ধি হতে থাকল। তবুও গুণগত মানের দিকে ঘাটাল মহকুমার ইট যথাযথ ও অপেক্ষাকৃত ভাল হওয়ায় বাইরের ইট এলেও তারা বাজার দখল করল বটে কিন্তু ঘাটালের ভাটাগুলাের উৎপাদন ব্যহত হল না।
কিন্তু সংকট দেখা দিল ইট শিল্পের মূল উপাদান ইটের মাটি নিয়ে। ঘাটাল মহকুমার পােড়া পতিত জমির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় ইট শিল্পে মাটির অপ্রতুলতা প্রবলভাবে দেখা দেওয়ায় চলতি ভাটার মধ্যে ৫টি ভাটার ইট উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকল। শিল্পে উৎপাদন কম হলে টিকে থাকা সম্ভব নয় তাই অচিরে এইসব ভাটাগুলি বন্ধ হয়ে গেল।
একদিকে যেমন মাটির সমস্যা অন্যদিকে শ্রমিক সমস্যা, দামের সমস্যা, রাজনীতির বড়বাবুদের দশবাজির সমস্যা, এইসব সমস্যা ডিঙিয়ে ব্যবসা চালানাে খুবই কঠিন হয়ে যাওয়ায় বাইরের আমদানীকৃত ইট একটা বড় অংশ দখল করে নিল। বাজার দামে আর উৎপাদন খরচে টাল রাখতে না পেরে অধিকাংশই ভাটাই দুর্বল হয়ে পড়ল। বিশেষতঃ বাইরের ইট ওভারলােড আইনকে বুড়াে আঙ্গুল দেখিয়ে বাজারজাত করতে পারলাে কেবলমাত্র রাস্তার টহলদারির বদান্যতায়। তাছাড়া কয়লাখনি অঞ্চলের ভাটাগুলির জ্বালানী খরচ কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের জ্বালানীতে নামমাত্র খরচ হওয়ায় অনায়াসে কম দামে মাল দিতে পারে। যা ঘাটালের উৎপাদকরাপারে না।
ইট ভাটা শিল্প একটি শ্রম নিবিড় শিল্প। কৃষির সহযােগী শিল্প এই ভাটা। ভাটা শিল্পে যারা কাজ করেন তারা কৃষির কাজ সেরে এই শিল্পে কাজ করতে আসেন এবং সিজিন শেষে বাড়ি ফিরে কৃষির কাজে নিযুক্ত হয়ে ৩৬৫ দিনই তাদের কাজের ধারা অব্যাহত রাখতে পারেন।
ইট ভাটা, সে নদীপাড়ে বা রাস্তার ধারে বা খালপাড়ে যেখানেই হােক না কেন ভাটার শ্রমিকরা প্রচলিত গঞ্জকে সমৃদ্ধ করে। আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছলতা থাকায় স্থানীয় বাজারে তাদের প্রভাব পড়ে। সপ্তাহান্তে মাথা পিছু শ্রমিককে ৫০০ টাকা করে খরচ দিতে হয়। এই খরচ বাজারে চাহিদা তৈরি করে বৈকি।
শ্রম নিবিড় এই শিল্পে শুধু ইট তৈরির শ্রমিক নয়, মাটি পরিবহণ, বালি পরিবহণ, পাকা ইট পরিবহণের জন্য ট্রলি, ইঞ্জিন ভ্যান, ছােট বা বড় ট্রাক প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। ফলে এলাকায় অন্যান্য শ্রমিকেরা এই কাজে পরােক্ষ ভাবে নিযুক্ত হন। সাম্প্রতিককালে ইট তৈরির কাজে যান্ত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার হওয়ায় ইট উৎপাদনের নানা কাজে সহায়ক হয়েছে, কিন্তু মজুরি ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় ইটের দামের সমতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। এলাকায় ভাটা থাকলে এবং মানুষ সহায়তা করলে কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ উপযােগিতা বাড়ে, কেননা (১) দেখা গিয়েছে অতিরিক্ত ফসলের আশায় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়ােগে জমির উপরিতলের মাটি তার উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। চাষী তখন বাধ্য হয় জমির উপরিতলের মাটি সরিয়ে জৈব সার প্রয়ােগ করে জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে যেটা চাষি নিখরচায় ভাটা মালিককে দিয়ে করিয়ে থাকেন। (২) অপেক্ষাকৃত উঁচু ও সেচের অনুপযােগী জমির অতিরিক্ত মাটি ভাটা মালিককে দিয়ে সরিয়ে চাষি অর্থের
সাশ্রয় করেন।। (৩) পুরানাে পতিত অকৃষি জমির মাটি ভাটা মালিককে দিয়ে সরিয়ে কৃষি জমির সম্প্রসারণ ঘটায়। ৪) মজে যাওয়া পুকুর ভাটা মালিককে দিয়ে নিখরচায় খনন করিয়ে চাষী চাষের প্রয়ােজনীয় জল সংরক্ষণ করে এবং সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
এইভাবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্যে ভাটাগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব কাজ করা যায় না।
সত্যি বলতে কি ভাটা যেহেতু গ্রামীণ বড় শিল্প সংস্থা, শয়ে শয়ে শ্রমিক কাজ করে, তাই গ্রামস্থ পরিবারের সাধভক্ষণ ছাড়া সমস্ত দায়-দফাতে ভাটা মালিকদের সহযােগিতা করতে হয়। ‘না’ বলা চলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ভাটা শিল্প এমনই শিল্প যে এখানে সরকারকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ভাটার মাপ অনুসারে হিসেব করলেই তার উৎপাদনের হিসেব খুঁজে পায় সরকার।
প্রতিটি ভাটাকে কম করে তিন থেকে দশ  লক্ষ টাকা রাজস্ব দিতে হয়। তাছাড়াও বছরে নানা পারমিশন, আবেদন, কত কি! খরচের শেষ নেই। তবে বলতে কি, গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ। আইন ও আদালত সম্পর্কিত সমস্যাগুলি  মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সরলীকরণ হয়েছে এটাকে অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এখন যা সমস্যা তা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে উদ্ভূত। উৎকণ্ঠার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে, তমলুক মেডিক্যাল কলেজ সহ অন্যান্য সরকারি নির্মাণে মাটির ইট বাদ পড়েছে। যা এই শিল্পের ভবিষ্যতের পক্ষে বিপজ্জনক।
সরকারি ভাবে বলা হচ্ছে যে, মাটির ইটে প্রাকৃতিক সম্পদ (মাটি) ধ্বংস হচ্ছে। এটা ক্রমশ বাড়লে পৃথিবীতে একদিন মাটির অভাব হবে। তাই যদি হয় তবে এখন যে বিকল্প ইট ব্যবহার করার আদেশ সরকার দিচ্ছে, যেমন (১) ফ্লাই এ্যাস ব্রিক (২) কংক্রিট ব্রিকস (৩) এ.এল.সি. ব্লক। এই তিন প্রকার ইটেই প্রাকৃতিক সম্পদ বালি যা  প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ন আসে, মাটির ইটের বেলায় যদি প্রাকৃতিক সম্পদ মাটি ধ্বংস হয়, বালি ও তাে প্রাকৃতিক সম্পদ, তার বেলায় ছাড় হয় কি করে? কেন্দ্রের এই চিন্তা ‘সােনার পাথর বাটী’নয় কি?

 

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।