মনসারাম কর, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল: বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্যে ঝড় তুলেছে রাজনৈতিক দল। শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে, ১৯৮২ সালে শিলান্যাস, তারপর টানা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চলছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নানান জল্পনা। কিন্তু কবে তা কার্যকর হবে বা আদৌ আর কার্যকর হবে কিনা তা জানেন না ঘাটালবাসী। মাস্টার প্ল্যানকে হাতিহার করে একের পর এক নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও এখনও অথৈ জলেই থেকেছে ঘাটাল মহকুমার মানুষ। ঘাটালবাসীর প্রশ্ন, মাস্টার প্ল্যান রাজনৈতিক দলগুলির কাছে শুধুই কী নির্বাচনী অস্ত্র? চল্লিশ বছর ধরে দফায় দফায় কেন্দ্র-রাজ্য ফাইল চালাচালির পরেও বর্তমানে অর্থ জটে আজও সরকারের ঠান্ডা ঘরেই আটকে রয়েছে ঘাটালের বন্যা নিয়ন্ত্রের মাস্টার প্ল্যান। অনেক দোলাচলের পর কেন্দ্রের প্লানিং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণে শেষ সবুজ সংকেত দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমে ঠিক হয়েছিল মোট খরচের ৭৫ শতাংশ দেবে কেন্দ্র এবং ২৫ শতাংশ দেবে রাজ্য, পরে ঠিক হয় প্রকল্পের মোট খরচের কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েই দেবে ৫০ শতাংশ করে খরচ। বর্তমানে রাজ্যের শাসক দলের অভিযোগ, কেন্দ্র মাস্টার প্ল্যান রুপায়নে সবুজ সংকেত দিলেও রাজ্যের হাতে প্রথম দফার বরাদ্দ টাকা দেয়নি, তাই মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করতে পারেনি রাজ্য। তাহলে কী কেন্দ্র রাজ্য শাসক দল এক হলে তবেই কার্যকর হবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? কয়েকদিন আগে বন্যা পরিদর্শনে এসে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্রের অসযোগীতার অভিযোগ তুলে ঘাটালের সাংসদ দেব বলেন, মমতা ব্যানার্জী প্রধানমন্ত্রী হলে তবেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর হবে, অন্যদিকে নির্বাচনের সময় বিজেপির হেবিওয়েট নেতৃত্বদের মুখে শোনা গেছিল কেন্দ্র রাজ্য ডবল ইঞ্জিনের সরকার তৈরি হলেই কার্যকর হবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। উভয়ের মন্তব্যে মাস্টার প্ল্যান রুপায়নের পেছনে কেন্দ্র রাজ্য শাসক দল এক হওয়ার একটা ইঙ্গিৎ থেকে গেছে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রুপায়ণ সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক আজ বলেন, দুই সরকারের সদিচ্ছা থাকলে মাস্টার প্ল্যান অবশ্যই রুপায়ণ হয়ে যেত, কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্দ করেনি, রাজ্য সরকার ছোট ছোট প্রকল্প করে কয়েকটা জায়গায় নদী সংস্কারের কাজ করলেও শীলাবতি সংস্কারে হাত দেয়নি, যেভাবে হোক ঘাটালকে বন্যা মুক্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্যকে আন্দোলন করতে হবে। এবার দেখে নেওয়া যাক মাস্টার প্ল্যানে কী কী কাজ হওয়ার কথা ছিল।
- কংশাবতী ও শিলাবতী বিস্তীর্ণ নদীপথ সংস্কার, * কেঠে ও কাটান খাল সংস্কার করে দুই পাড়ে স্থায়ী বাঁধ তৈরি করা, *ঘাটালের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলির সংযোগস্থলের বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রচালিত লক গেট বাসানো, *কাঁসাই পলাশপাই দুর্বাচটি সহ বিভিন্ন নদী ও খাল সংস্কার, *ঘাটাল মহকুমাজুড়ে বিভিন্ন নদীবাঁধ মেরামত করা, *জল নিকাশের জন্য চন্দ্রকোনা-ঘাটাল-দাসপুরের বহু জায়গায় পাম্প হাউস তৈরি
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে তৎকালীন সেচমন্ত্রী ঘাটাল মাস্টরা প্ল্যানের শিলান্যাস করেন। শিলান্যাসের পর কোনও অজানা কারনে দীর্ঘকাল কাজ থমকে থাকায় ২০০১ সালে মাস্টার প্ল্যান রুপায়নের দাবিতে ঘাটালে শুরু হয় আন্দোলন, তৈরি হয় এক অরাজনৈতিক সংগ্রাম কমিটি। ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘাটাল পরিদর্শনে আসেন, কাজের জন্য ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি হয় এবং প্রথম দফায় ৩৫০কোটি টাকা দিয়ে কাজ শুরু করার কর্মসূচী নেওয়া হয়, পরে নানান টালবাহানার কারনে ফের ঠান্ডা ঘরে চলে যায় মাস্টার প্ল্যানের কাজ। ২০০৯ সালে ফের প্রকল্প খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করে রাজ্য সরকার, নতুনভাবে প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ১৭৮০কোটি টাকা। ২০১০ সালে গঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রনের অধিনে প্রকল্পের নতুন ডিপিআর জামা পড়ে। ২০১১ সালে আরও কিছু তথ্য জানতে চেয়ে ডিপিআর রাজ্য সরকারের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। ফের নতুন ডিপিআর তৈরির পর সংশোধিত ডিপিআর পুনরায় জমা পড়ে কেন্দ্রের কাছে। পদ্ধতিগত ভুল থাকায় আবার ফেরত আসে ডিপিআর। ২০১৩ সালে খরগপুর আইআইটির বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন ডিপিআর তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালের মে মাসে মাস্টার প্লান কার্যকর করতে ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথম পর্যায়ে খরচ ধরা হয় ১২১৪ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা। কিন্তু ঘাটালের মানুষের কাছে আজও অধরা সেই বহু চর্চিত ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। বন্যার সময় জলবন্দীদশা, নৌকা, ডিঙি, ছাদে বাস করা, অন্যের বাড়িতে রাত কাটানো ঘাটালের মানুষের চেনা ছবি। তবুও অপেক্ষা চলছে।