উমাশঙ্কর নিয়োগী:👆 •পঞ্চ অঙ্গিকাই পঞ্জিকা নাকি পঞ্জি থেকে পঞ্জিকা বা পাঁজি এসেছে সেটা ভাষাতত্ত্ববিদরা বলতে পারবেন। কিন্তু পাঁজি ‘কুসংস্কারের আঁতুড় ঘর’ বলে এক শ্রেণির মানুষ যতই নাক সিটকান না কেন; বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ এবং করণ,বারো মাসের প্রতি দিনের এই পাঁচটি তথ্য নিয়ে প্রত্যেক বছর ১লা বৈশাখ থেকে যে গ্রন্থ বাঙালি হিন্দুদের ঘরে ঘরে সমাদৃত হয় তা নতুন পাঁজি নামেই সুপরিচিত। হিন্দুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থে গর্ভাধান, পঞ্চামৃত, সাধভক্ষণ, নামকরণ, চূড়াকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহের দিন এমন কী মৃত্যুর সময়, বার-তিথি-নক্ষত্রের দোষ লাগল কিনা জানতে পাঁজির শরণাপন্ন হতে হয়। ঠিকুজিকুষ্ঠি রচনা করতে শুভাশুভ দিন ক্ষণ দেখতে সবেতেই পাঁজি নির্ভর আমরা।
সাতটি বার (১), পনেরটি করে শুক্ল এবং কৃষ্ণ পক্ষের তিথি (২) ও সাতাশটি নক্ষত্র(৩) এদের প্রত্যেকের অধিপতি একজন করে দেব অথবা দেবী। সিদ্ধি, নক্ষত্রামৃত, তিথ্যমৃত, ইত্যাদি সাতাশটি যোগ(৪)। বব, বালব,কৌলব,তৈতিলাদি এগারোটি করণ(৫)। এই পঞ্চ অঙ্গের সমন্বয়ে পঞ্জিকা তথা পাঁজি রচিত হয়।
কোন সুদূর অতীতের কোন সময় আমাদের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহেরা সময়, দিন, মাস, বছর গণনার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন তা মৌন অতীতই জানে। প্রয়োজনের তাগিদে গণনার কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবীর সুপ্রাচীন মায়া সভ্যতার বাসিন্দারা বছর গণনা করত। তাদের দিনের সংখ্যা ছিল ৩৫৬.২৪২০দিন। হন্ডুরাসের কোপানে মায়াদের মন্দিরে ৩৫৬টি সিঁড়ি মায়া পঞ্জিকা অনুসারে তৈরি। মেক্সিকোর চিচেন ইয়েৎ সার’এ ‘এল কাস্তিল্লো’ একটি আশ্চর্য মঞ্চ। মঞ্চে ওঠার জন্য চারদিক থেকে ৯১টি করে সিঁড়ি উঠেছে। উপরের মঞ্চ নিয়ে মোট সংখ্যা ৩৬৫। পণ্ডিতদের অনুমান এটিও একটি পঞ্জিকা।
আমাদের ঋগ্বেদে দ্বাদশ মাসের উল্লেখ আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে বারো মাসের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন মুনিঋষিরা। এই বারো মাসের নাম হল মধু-মাধব(ফাল্গুন-চৈত্র)শুক্র-শুচি(বৈশাখ- জৈষ্ঠ্য)নভস-নভস্য(আষাঢ়-শ্রাবণ) ঈষ-ঊর্জ(ভাদ্র-আশ্বিন) তপস- তপস্য(কার্তিক-অগ্রহায়ণ) সহস- সহস্য(পৌষ-মাঘ)। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যজুর্বেদ রচিত হয়েছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। এই যজুর্বেদে ফাল্গুনী পূর্ণিমা ও বার মাসের উল্লেখ দেখা যায়। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে ১২টি মাস, ২৭টি নক্ষত্র ও ৩০টি তিথি নিয়ে গণিত অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত পঞ্জিকা ব্যবহার হত তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। খ্রিস্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতকে আর্যভট্ট (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) বরাহ-মিহির (৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ)জ্যোতির্বিদ্যার উপর ভিত্তি করে নতুনভাবে পঞ্জিকা রচনা করেন।বলা যেতে পারে বরাহমিহিরের ‘সূর্য্যসিদ্ধান্ত’ আধুনিক পঞ্জিকার জন্মদাতা।
বঙ্গে পাঁজিও কম দিনের নয়। তা নয় নয় করেও পাঁচ শতাধিক বছরের পুরানো। স্মার্ত রঘুনন্দনের জন্ম চৈতন্যদেবের জন্মের(১৪৮৬খ্রিস্টাব্দ) পঁচিশ বছর পরে। রঘুনন্দন তালপাতায় পাঁজি লিখে প্রকাশ করতেন। তা অনুলিখিত হয়ে সারা বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ত। বহু পূর্বে গ্রহ বিপ্রগণ(আচার্য) গ্রামে গ্রামে গিয়ে শুভ দিন ক্ষণ শুনিয়ে যেতেন। অনেক সময় গণনার পার্থক্য হত। এই দোষ নিরসনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজ্যে ‘ নবদ্বীপ পঞ্জিকা নামে পাঁজির প্রচলন করেন। তিনি তাঁর (১৭১০-১৭৮২ খ্রিঃ) আশ্রিত পণ্ডিত বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণবকে দিয়ে তুলট কাগজে পাঁজি রচনা করিয়ে অনুলিপি রাজ্যময় ছড়িয়ে দিতেন। পরে রাজসভার পণ্ডিত রামরুদ্র বিদ্যানিধির উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়।
১৮১৮খ্রিস্টাব্দে ছাপা বাংলা হরফে প্রথম পাঁজি প্রকাশিত হয়। জোড়াসাঁকোর জনৈক দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ পাঁজির সংকলক ও প্রকাশক ছিলেন রামহরি। ১৩৫ পাতার এই পাঁজিটি জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘দীনসিন্ধু’ প্রেসে পাঁজি ছাপা হত। ১৮৩৯খ্রিস্টাব্দে পঞ্চানন কর্মকারের জামাই মনোহর দাস নিজের প্রেস থেকে একটি পাঁজি বের করেছিলেন। রেভারেন্ড লং সাহেবের বর্ণনা থেকে জানা যায় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরের ‘চন্দ্রোদয়’ প্রেস থেকে এক আনা দামের আশি পৃষ্ঠার একটি পাঁজির লক্ষাধিক কপি করে প্রতি বছর ছাপানো হত। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাচরণ গুপ্তের প্রেস থেকে ‘গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা’ নামে একটি পাঁজি প্রকাশিত হয়ে অদ্যাবধি এই পাঁজি চলছে। ১৮৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে বলরাম দে প্রথম ‘বেঙ্গলি অ্যালমানাক অ্যান্ড ডাইরেক্টরি’ নামে প্রথম ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। ১৮৮৮খ্রিস্টাব্দে কিশোরীমোহন বাগচী তাঁদের কারখানায় প্রস্তুত সরস্বতী মার্কা কালির বিজ্ঞাপন দেবার জন্য নিজেরা পি এম বাগচি পঞ্জিকা নামে একটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পি এম বাগচি কোম্পানি পাঁচ সিকা (এক টাকা চার আনা) মূল্যের পাঁচশো পাতার একটি ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা প্রকাশ করে। পি এম বাগচি পাঁজির ওই সংখ্যাটি ষাট সত্তর হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে চলে আসা ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ ছাড়াও বাজারে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র শীলের পঞ্জিকা যা পরে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা নামে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, মদন গুপ্ত ইত্যাদি নামে বহু পাঁজি প্রচলিত আছে। এ বিষয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত একশোর বেশি ছাপা পাঁজি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে যার অনেকগুলোই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বাঙালি হিন্দুদের জীবনে পাঁজি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বাংলা প্রকাশনা জগতে এখনো বেস্টসেলার পাঁজি। নিজের উৎপাদিত জিনিসের গুণাগুণ সহজে বহুজনের কাছে পৌঁছে দেবার ও গ্রাম বাংলার মানুষকে বিজ্ঞাপনের কুহক জালে আবদ্ধ করে ঠকানোর শ্রেষ্ঠ উপায় পাঁজিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া।
•তথ্য সহায়তা:১:ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’। ২:আনন্দবাজার পত্রিকা এপ্রিল ২০১২ ‘‘রবিবাসরীয় প্রবন্ধ’। ৩: সৌভিক মুখোপাধ্যায় ‘পি এম বাগচি ও সেই সময়কার কলকাতা’। ৪: শ্যামসুন্দর বেরা ‘পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনে বদলে যাওয়া সমাজ চিত্র’। ৫: শ্রীপান্থ ‘যখন ছাপাখানা এলো’। ৬: স্বামী বিজ্ঞানানন্দ মহারাজ ‘সূর্য্যসিদ্ধান্ত’
👆 আমাদের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলটি লাইক করুন