‘২১ শে ফেব্রুয়ারি’ —উমাশঙ্কর নিয়োগী
•১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট সংস্কৃতি ভাষা আচার আচরণ পোশাক- আশাক এমনকি কান্না -হাসির ভাষাও এক তবুও মূলত কিছু মানুষের ক্ষমতাসীন হওয়ার তীব্র ইচ্ছা পূরণের তাগিদ থেকে ধর্মের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারত টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমরা ত্রিখণ্ডিত দেশমাতৃকার দেহ নিয়ে স্বাধীন হলাম।
নবজাতক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ৫৬% বাংলা ২৯%পাঞ্জাবি ৩.৫% উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু মৌলবাদীদের অনুপ্রেরণায় পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসককুলের কর্ণধার মহম্মদ আলি জিন্নাহ, লিয়াকত আলি প্রমুখ নেতৃত্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ভাষা হবে বলে ঘোষণা করে দিলেন ।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ঢাকার সুরুজ্জামান মেসের একটি ঘরে ‘পূর্ব পাকিস্তান তমুদ্দুন মজলিস ‘ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠন ১৫ই সেপ্টেম্বর ‘ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ‘এই নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে । পত্রিকাটিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। মুহূর্তে পুস্তিকাটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঐ বৎসরের ৪ঠা নভেম্বর ‘সাংবাদিক সংঘ’ এবং ‘ সাহিত্য সংসদ ‘ প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।৫ই ডিসেম্বর করাচিতে শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৬ ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলাতে ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম পথসভা করে। মুনির চৌধুরী বাংলা ভাষার পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি ওঠে।ছাত্র ও জনতা স্বতস্ফূর্ত ভাবে তা সমর্থন করে।
ইতিমধ্যে পাকিস্তান রেডিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বর্জন করেছে। উর্দু মিশেল এক অদ্ভুত বাংলা ভাষা চালু করার সরকারি চেষ্টা শুরু হয়েছে। ১৯৪৮, ২৩শে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বিলে একটি সংশোধনী এনে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের নেতৃত্বে সরকার, গণপরিষদ এই সংশোধনী গ্রহণ করল না। এর প্রতিবাদে পুর্ব পাকিস্তানে ১১ই মার্চ ধর্মঘট হয়। বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রযুবরা। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক লাঠিচার্জ ও ধরপাকড় করে । ১৯শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ এবং ভাষা আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্য ঢাকায় এলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ। সমাবর্তনে তিনি কেবলমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। ছাত্ররা সমবেত ভাবে প্রতিবাদ জানায়। তাঁর জনসভাতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১১ই মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা দিবস’হিসেবে পালন করা হচ্ছিল।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে আসেন ২৬শে জানুয়ারি । তিনিও উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলেন। স্তিমিত ভাষা আন্দোলনে ঘৃতাহুতি পড়ল। শিক্ষক নেতা গাজিউল হকের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৩০শে জানুয়ারি সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করা হল। আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ বাংলা ভাষা কর্ম পরিষদ ‘ গঠিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘ বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নরুল আমিন ২১শ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধার জারি করলেন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। কলা ভবনের প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই ছাত্ররা দশজন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেফতার বরণ করতে থাকে। ক্রমশ আইন ভঙ্গকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেলা তিনটের সময় ঢাকার রাস্তায় মিলিটারি নামে। বেলা ৩টা ১০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ঢুকে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে আরম্ভ করে। গুলিতে নিহত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল জব্বার, আবুল বরকত,সালাউদ্দিন, হেমচন্দ্র কলেজের রফিকউদ্দিন আহম্মদ।৩০০ জন আহত হন গ্রেফতার করা হয়েছিল ১৮০ জনকে।এঁরা ছাড়া আরো কত জন ঐ দিন নিহত হয়েছিলেন তার কোনো হিসেব নেই। রাতারাতি ছাত্ররা একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করে ফেলে। ২২ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। জনতা এই হত্যার প্রতিবাদে শহিদদের রক্তমাখা কাপড় নিয়ে শান্তিপূর্ণ শোকমিছিল বের করে। পুলিশ আবার গুলি চালিয়ে হত্যা করে শফিউর রহমান, আবদুস সালাম এবং আউয়াল সহ অনেককে। ভাষা শহিদ রিকশা চালক আউয়ালের সাত বছরের মেয়ে বাসিরা শহিদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে। পুনরায় এগার ফুট উঁচু শহিদ মিনার নির্মাণ করে ছাত্ররা।
আহত ছাত্রদের হাসপাতালে দেখতে এলেন সাংবাদিক আবদুল গফ্ফর চৌধুরী। একটি ছেঁড়া কাগজের টুকরোতে লিখে ফেললেন কয়েক ছত্র,
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু -গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।।”
কথাতে সুর সৃষ্টি করলেন আলতাফ মাহমুদ। এই গান সম্পর্কে সুদিন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ” এ শুধু গান নয়, ছন্দের বিস্তার নয়, সুরের উচ্চারণ নয়।এ একটি জাতির বিশ্বাস -বেদনা , আনন্দ- অহংকার, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদের প্রতীক। মন্ত্রের মতো অমোঘ উচ্চারণ,প্রত্যয়ে দৃঢ়,অঙ্গীকারে দৃপ্ত।এ কবিতার চরণে চরণে ঝঙ্কার তোলে আমাদের ব্যথিত হৃৎপিণ্ডের ক্রমিক স্পন্দন, আমাদের চৈতন্যের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে পাখি -ডাকা ভোরের শিহরিত জাগরণ। আজ এ গান ইতিহাস- গর্বের ,আদরের ,আত্মানুসন্ধানের ও আত্ম আবিষ্কারের। ”
২২ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লাল দিঘির মাঠে এক বিশাল প্রতিবাদ সভা হয়েছিল। মাহবুব- উল – আলম চৌধুরীর লেখা ‘ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ‘ কবিতা পাঠ করা হয়েছিল। কবিতার কয়েকটি চরণ হল,
“এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নীচে
সেখানে আগুনের ফুলকির মত
এখানে ওখানে জ্বলছে রক্তের আলপনা,
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি
যারা আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত
মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে
আমার এইসব ভাইবোনদের হত্যা করেছে
তাদের আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।”
২৬ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ শহিদমিনারটি পুনরায় ধূলিসাৎ করে দেয়। আলাউদ্দিন আজাদ শহিদমিনার ভাঙা নিয়ে একটি কালজয়ী কবিতা রচনা করেন। কবিতার কিছু অংশ,
“স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। ***
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক
ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার
আমরা জাগরী চার কোটি পরিবার।”
এই ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ক্ষেত্রে ভাষা ভিত্তিক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। রফিকুল ইসলাম আর আবদুল সালামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর পুরুলিয়ার খানিকটা অংশ বিহারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এক হাজার বাঙালি পায়ে হেঁটে কলকাতায় আসেন। দীর্ঘ সংগ্রামে তাদের সাফল্য আসে। পুরুলিয়ার অংশ থাকে পশ্চিমবঙ্গেই।
অসমের বরাক উপত্যকার অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। অসম সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূ-লুণ্ঠিত করার অপচেষ্টা শুরু করে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে মিছিল বেরিয়েছিল তার উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে।শহিদ হন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য, হিতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর , সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী,সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ,কুমুদ দাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, শচীন শীল,সত্যেন্দ্র দেব। এ ইতিহাসও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।