ব্রাত্য শিল্পের অন্ধকারে কবিয়াল বিষ্ণু চক্রবর্তী/—দুর্গাপদ ঘাঁটি
“ওদের হাম্বা শুনে দু’টি কথা বলতে হ’লো
কাশ্মিরী শাল বোম্বে থেকে খবর এলো
যা শুনিনা কোন কালে
বাঘ মারিবে রাম ছাগলে?
শৃগাল বলে সিংহের ছলে
হার মানাবে আমারে… ।”
অথবা
“আজ হরি-
তোমার রাঙা চরণ দেখাও আমারে
ও তোমার চরণ রাসে।
দেশ-বিদেশে এই অধমের ঘন ঘোরে
আজ হরি, তোমার তুমি হও ভক্তের ভগবান।”
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেও এমনই কত তরজা গানে অনুরণিত হত বাংলার আকাশ বাতাস যার কথা পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক ব্যক্তি সবাইকার স্মৃতি এখনও বিস্মৃতি হয়ে যায়নি।আজকাল কি যেন অাধুনিক ডি জে না জে.ভি.এলএর যন্ত্রণাদায়ক ঢিপ ঢিপ জীবনঘাতি শব্দ অথবা মাল্টিমিডিয়ার ঝকঝকে সাংস্কৃতিতে চাপা পড়ে গেছে সেই শিল্প।এনিয়েই প্রবীন কবিয়াল বিষ্ণু চক্রবর্তীর উদ্বেগ-যে শিল্পে প্রাণ নেই তাকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কেন?
সেই মধ্যযুগে কবি গানের উৎপত্তি। মাঝে কিছুদিন থেমেগিয়েছিল বটে রসিক রাজন্যবর্গ ও বিত্তবান শ্রেণীর উৎসাহে তা পুনরায় জাগরিত হয়।তারপর এগিয়ে চলে শত শত বছর ধরে। রসিয়ে রসিয়ে কবি গান গেয়ে এঁরা প্রথমে আখ্যায়িত হন কবিওয়ালা পরে কবিয়াল নামে।বিভিন্ন পূজানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অথবা রসিক বিত্তবানদের আনন্দ দিতে মূলতঃ কবি গানের অাসর বসত।যন্ত্র বলতে একটি ঢোল একটি কাঁসি। এমনই বাদ্য নিয়েই বিখ্যাত হয়েছিলেন এন্টনি ফিরিঙ্গি,হারু ঠাকুর,ভোলা ময়রার মতো প্রমূখ কবিয়ালগন। তাঁদেরই ট্রাডিশন রাখতেই কবিয়াল বিষ্ণু চক্রবর্তী বাংলার বুকে কবিগান গেয়ে দাপটের সঙ্গে দিক্ বিদিক জয় করেন।
রুগ্ন ও শুষ্ক চেহারা।ছোট্ট কুটির ও শরীরে দারিদ্রতার স্পষ্ট ছাপ।তথাপি সদাই হাসি তাঁর ভাঙাচোরা গালে।কেমন আছেন এমন কুশল বিনিময়ে-হাসি মুখে সদয় জবাব-ভালো।
প্রকৃত শিল্পীরা বোধ করি এমনই হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুন্নিবৃত্তি মুখের হাসি ও শিল্পের আবেগকে ম্লান করতে পারে না।কবিয়াল বিষ্ণু চক্রবর্তী তেমনই একজন শিল্পী যিনি সংসারের ঢালু পথের সংকীর্ণ গণ্ডি টপকে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে মানুষকে বিনোদন দিতে দেশদেশান্তরে তরজা পরিবেশন করে বেড়িয়েছেন। তাঁর গুরু ছিলেন তৎকালীন বাঙলার বিখ্যাত কবিয়াল গোপালকৃষ্ণ অধিকারী।
প্রায় পাঁচ দশক পূর্বে বর্ধমান বিভাগীয় লোক সংস্কৃতি উৎসবে গানের জালে জড়িয়ে পশ্চিম বাঙলার একে একে চারশো বাঘা বাঘা কবিয়ালকে পরাজিত ক’রে পুরস্কার জিতে বাংলার প্রথম সারির কবিয়ালের খাতায় স্থান করে নিয়েছেন।বাংলার ছন্দময় অনুকূল পরিবেশে প্রাচীন লোকগাঁথা ও পুরানকে অবলম্বন করে তরজা ফেরি করেছেন গ্রাম থেকে শহরে-গোটা বাংলায় ও ভিন রজ্যেও। কবিয়ালদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তরজার লড়াইতে হঠাৎ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বিরোধী পক্ষকে কুপাকাত করতে তাৎক্ষণিকভাবে ছড়া ও সুর তৈরি করা।কবিয়াল চক্রবর্তী এ বিযয়ে অসম্ভব পটু ছিলেন।তাঁর তৈরি অসংখ্য ছড়া পরবর্তী প্রজন্মের কবিয়ালদের মুখে মুখে ঘোরে ফেরে আজও। তিনি পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি পর্ষদ কর্তৃক সম্মানও।
বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার রামপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। স্ত্রী মনোরমা দেবী ও দুই সন্তানকে নিয়ে কষ্টের সংসার।
অনেক জায়গায় বহু পুরস্কার,বহু সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি। হাজার হাজার মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেও ভাঙা ঘরে দিন কাটাচ্ছেন আজ। এখন তাঁর খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেননি কেউ।তা যাইহোক আশি উত্তীর্ণ শিল্পীর বয়সের ভারে শরীর অসক্ত হয়েছে,গাইতেও পারেন না তেমন। কিন্তু যেকারণে তাঁর এ ডোরে বাঁধা ছিলো জীবন,সেই ঢোল কাঁসির আওয়াজ এখন আর শুনতে পানননা তেমন,আসরে আর হাজার হাজার মানুষের ভীড় দেখতেও পান না। মাল্টিমিডিয়া তাঁদের ঢোল-কাঁসির সুর কেড়ে নিয়েছে যে।ভাঙা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আজও ভাবেন আর কি বসবে সেই তরজার আসর?
তবু্ও আশাবাদী এই প্রবীণ শিল্পী উঠোনে বসে প্রার্থনা করে চলছেন সুদীনের আশায়। এখনও খুঁজে পেতে চান সেই সুর-ছন্দ সেই ঢোল কাঁসির আওয়াজ অথবা ভোলা ময়রার লেখা সেই তরজার কৌতুক ছড়া-
“রংপুরের শ্বশুর ভালো রাজশাহীর জামাই
নোয়াখালীর নৌকা ভালো চট্টগ্রামের ধাই…।”