কুণাল সিংহরায়: থ্যালাসেমিয়া আসলে একটি গ্রীক শব্দ। থ্যালাসা কথার অর্থ সমুদ্র আর অ্যানেমিয়া হল রক্তাল্পতা। কথিত আছে গ্রীসের কোন এক সমুদ্রের ধারে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন এবং প্রমাণ করেন এটি রক্তের বংশগত অসুখ। প্রধানত জিনগত সমস্যা থেকেই এই রোগের সৃষ্টি যা বংশানুক্রমিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রোগাক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হয় না হিমোগ্লোবিন এর ত্রুটির কারণে। লোহিত রক্তকণিকার আয়তন ছোট হয় ফলে রোগাক্রান্ত ব্যাক্তিকে রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করতে হয়।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বাহ্যিক কোন কারণ নেই। বাবা মার কাছ থেকেই সন্তানের শরীরে এই রোগ আসে।এটি কোনওভাবেই ছোঁয়াচে বা সংক্রামক নয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত অন্য ব্যাক্তির দেহে দেওয়া হলেও তিনি এই রোগে আক্রান্ত হবেন না। যৌন সংসর্গেও এই রোগ ছড়ায় না।
থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দুই প্রকারের– মেজর ও মাইনর। যারা এই রোগের বাহক তাদেরই মাইনর থ্যালাসেমিয়া বলা হয় আর মেজর থ্যালাসেমিয়া হয় সদ্যজাতদের যারা রোগের শিকার হয়েই জন্মায়। মাইনর থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষ্মণ দেখা যায় না, পরীক্ষা না করলে জানাই যায় না তিনি থ্যালাসেমিয়া বাহক অপরদিকে মেজর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর রোগ জন্মের ৬ মাসের মধ্যেই ধরা পড়ে যায় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায়। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ক্ষিদে না থাকা, জ্বরসর্দি, ফ্যাকাসে ভাব দেখে সহজেই বোঝা যায় শিশুটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তবে নির্দিষ্ট পরীক্ষার পরেই চিকিৎসকরা এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এই রোগ নির্ণয়ের জন্য HPLC বা High Performance liquid Chromatography করা হয়। রোগ ধরা পড়লে মাইনর থ্যালাসেমিয়ার কোন চিকিৎসা নেই, বলা ভালো প্রয়োজনও হয় না কিন্তু মেজর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে নিয়মিত রক্তগ্রহণ ছাড়া বিকল্প চিকিৎসা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রক্ত দেওয়ার সময়সীমা চিকিৎসকরাই নির্ধারণ করে থাকেন তবে শিশুর জন্মের প্রথম ছয়মাসের মধ্যে হলে সুপার ট্রান্সফিউসান প্রোগ্রামে রক্ত দেওয়া হয় যাতে করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ গ্রামের নিচে নামতে দেওয়া হয় না। এই চিকিৎসার ফলে শিশুটি ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অপরদিকে পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় হাইপার ট্রান্সফিউশান পদ্ধতি, এখানে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১০ থেকে ১২ গ্রামের মধ্যে রাখা হয়।আরো একটি পদ্ধতি হল সেফ লেভেল, এক্ষেত্রে আক্রান্তকে প্রতি সপ্তাহে একবার করে রক্তগ্রহণ করে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৭ থেকে ৯ গ্রামের মধ্যে ধরে রাখতে হয়।
আধুনিক চিকিৎসা হিসাবে Bone Marrow Transplant বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন চালু হলেও এটি খুবই জটিল এবং অত্যন্ত ব্যায়বহুল। বলে রাখা ভালো এই পদ্ধতিতে আশানুরূপ ফল এখনো মেলেনি।
এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে অবশ্যই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। একজন বাহকের সাথে আর এক বাহকের বিয়ে কোনওমতেই উচিত নয়। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাহক হন তাহলে ভ্রুণের বয়স ৮-১২ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে ভ্রুণটি আক্রান্ত হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে শুনতে খারাপ লাগলেও ভ্রুণটিকে নষ্ট করে দেওয়াই বাস্তবোচিত হবে কারন জন্ম থেকেই হাহাকার করবে রক্তের জন্য আর তাও মাত্র তিরিশটি বছরের আয়ু নিয়ে, তার এই পৃথিবীর আলো না দেখাই ভালো! তাই বিয়ের আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করান।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সবথেকে বেশি এই রোগাক্রান্ত বর্ধমান জেলায়। পরেই আছে আমাদের পাশাপাশি জেলাগুলি।এই রোগের চিকিৎসা সব জেলা হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজের ইউনিটে হয়।তবে আমাদের ঘাটালে শুধুমাত্র রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আলাদা বহির্বিভাগ, রক্তসঞ্চালন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার ইউনিট অনেক জায়গাতেই আছে। সম্প্রতি সরকারি নির্দেশে সমস্ত বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে এই পরীক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের এই পরীক্ষা করেও দেওয়া হচ্ছে।
ভারতকে বলা হয়ে থাকে থ্যালাসেমিয়ার রাজধানী। করোনা প্রকোপের আগের তথ্য অনুযায়ী এই দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারেরও বেশি শিশু রোগটি নিয়ে জন্মায় এবং এই শিশুদের অর্ধেকের বেশি ২০ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি ভারতে এই রোগের শিকার ছিলেন ৪০ লক্ষেরও বেশী মানুষ। Metropolis Health Care -এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতি দুজন মহিলার একজন রক্তাল্পতা বা অ্যানেমিয়ায় আক্রান্ত।
৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এই বছর আমাদের শপথ আমাদের প্রাণপ্রিয় ঘাটাল মহকুমায় ব্যাপক সচেতনতা প্রসার ও প্রচার এবং অবশ্যই পরীক্ষা শিবিরের ব্যবস্থা করা।