তৃপ্তি পাল কর্মকার:পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে-দৌড়ে, হেসে-খেলে দিব্যি কাটছিল ছোট্ট পিউ’র। কিন্তু দুই মায়ের টানাটানির ফলে ২ জানুয়ারি থেকে এক প্রকার বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে ১২ বছরের পিউকে। নিজে কোনও অপরাধ না করলেও আইনের গেরোয় তাকে চলে যেতে হয়েছে মেদিনীপুরের শিশু কল্যাণ কমিটির হেফাজতে। বর্তমানে সে চাইল্ডলাইনের মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বালিকা হোমে। আর সেই হোমের জানালার রড ধরে টপ-টপ করে চোখের জল ফেলে এক-একটা দিন কাটাতে হচ্ছে ঘাটাল থানার বরদা অজবনগরে বড় হওয়া পিউকে। কারণ, বর্তমানে পিউ’র দাবিদার দু’জন। একজন পালিতা মা অজবনগরের বাসিন্দা ছবি দোলই অন্য জন গর্ভধারিণী মা খড়ার শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইতু সামন্ত। কেউই ছাড়তে চাননি পিউ’র অধিকার। তাই পিউ’র এই অবস্থা। চাইল্ডলাইনের ঘাটাল সেন্টার হেড প্রদীপ শাসমল বলেন, পিউ বর্তমানে শিশু কল্যাণ সমিতির বিচারাধীন। তাই কবে কোন মায়ের কাছে পিউ ফিরে আসতে পারবে তা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। •পালিতা মায়ের বুকফাটা কান্নার ভিডিও
কেন শুরু হল দুই মায়ের আইনি লড়াই? কেনই বা এতদিন পর মেয়ের দাবিতে গর্ভধারিণী? সে কাহিনীও বড়ো মর্মান্তিক! বছর দশেক আগেকার কথা, ঘাটাল থানার খড়ার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গোপাল সামন্ত প্রায় মদ খেয়ে মারধোর করতেন স্ত্রী ইতুদেবীকে। খেতেও দিতেন না। হালকা মানসিক ভারসাম্যহীন ইতুদেবীর তিন ছেলের পর মেয়ে হয়। নাম দেন রানি। কোলের বছর দুয়ের মেয়েটিকে নিয়ে ভিক্ষে চাইতে চলে যেতেন এখানে ওখানে। এরপর পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ইতুদেবী। ঠিকঠাক সব যখন মনে পড়ল, তখন তিনি দিল্লির এক আশ্রমে। কেটে গিয়েছে পাঁচটি বছর। তিন ছেলে রকি, বিকি, বাণীর কথা মনে পড়লেও মেয়ে রানিকে কোথায় হারিয়ে ফেলেছেন মনে করতে পারেননি তিনি। ইতুদেবী নাম ঠিকানা সব জানালে দিল্লির ওই আশ্রম থেকে ইতুদেবীকে খড়ার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফিরে আসার কিছুদিন পর ইতুদেবীর স্বামী গোপালবাবু মারা যান। ছেলেরা যে যার পেশাগত কাজে লেগে পড়েছে। বছরখানেক আগে ইতুদেবীর বড় ছেলে রকি তার বোন কার বাড়িতে বড়ো হচ্ছে সে কথা জানতে পারে। মাকে নিয়ে একবার বোনকে দেখেও আসে। ২জানুয়ারি ইতুদেবী মেয়েকে ফেরত চান। কিন্তু ছবিদেবী এবং তার স্বামী দেবুবাবু মেয়ের অধিকার ছাড়তে রাজি হননি। তখনই বিষয়টি নিয়ে ঘাটাল থানার দারস্থ হন ইতুদেবী। ঘাটাল থানা থেকে বিষয়টি চাইল্ডলাইনকে জানানো হয়। বালিকাটিকে উদ্ধার করে ঘাটাল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই চোখের জল আর গগনভেদী আর্তনাদ করতে করতে পিউকে চলে যেতে হয় মেদিনীপুরের শিশু কল্যাণ কমিটির হেফাজতে।
বর্তমানে পুরো বিষয়টিই শিশু কল্যাণ কমিটির বিচারাধীন। বুক ফেটে গেলেও মেয়েকে কাছে না পেয়ে অজবনগরের দোলই বাড়িতে কান্নার রোল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন ছবিদেবী। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল দেবুবাবুর। দেবুবাবু বলেন সাড়ে নয়- দশ বছর আগে আমি ঘাটাল-ক্ষীরপাই রাস্তার পাশের এক খালের ধার থেকে বছর দুয়ের শিশুটিকে কুড়িয়ে এনে আমার স্ত্রীর কোলে তুলে দিই। আমাদের পরিচয়ে তার সমস্ত কাগজপত্র করি। পরম মমতায় দশ বছর ধরে আমার দুই ছেলের সঙ্গে বড়ো হয়েছে আমাদের পিউ। আজ কেউ এসে চাইলে আমরা মেয়েকে কেন দেব?
ছবিদেবীর বাড়িতে ২ জানুয়ারি থেকে খাওয়ানো যায়নি কাউকে। প্রতিবেশীদের হাজার চেষ্টাতেও জলটাও খাননি ছবিদেবী। মেয়ে কোলে আসবে আর তাকে আদর করতে করতে দুজনে একসঙ্গে খাবেন বলে রাস্তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছবিদেবী।