অতনুকুমার মাহিন্দার: ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা (বিদ্যাসাগর) প্রণীত বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের দশম পাঠে ভুবন ও তার মাসির পাঠ্যটি পাঠশালায় । যেখানে ছোট্ট ভুবনকে তার মাসি উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত শিক্ষাটি দেয়নি। ফলে সেই ভুবন এক সময়ে পেশাদার চোরে পরিণত হয় এবং বিচারক তার ফাঁসির হুকুম দেন। গল্পের শেষ ভাগে দেখি; ভুবন তার মাসির কান কামড়ে, দঁাত দিয়ে কেটে নিয়ে বলছে, মাসি তুমিই আমার এই ফঁাসির কারণ। আমি যখন প্রথমে পাঠশালায় বই চুরি করেছিলাম, তখন সব জেনেও তুমি আমাকে শাসন করনি কেন?
এই তথাকথিত সভ্য সমাজটির সার্বিক অবক্ষয়ের ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে চলা দেখে, ভুবনের সেই শতবর্ষ প্রাচীন প্রশ্নটির কথা বারবার মনে পড়ে। কিন্তু উত্তর দেবে কে? পারিবারিক আঁতুড় ঘর থেকে সমাজের রন্ধে রন্ধে আজ চরম হাহাকার। শাসন কোথায়? শুধু তীব্র অসন্তোষ। অশান্তি আর হিংসা। কেড়ে নেওয়া, ছিনিয়ে নেওয়ার ধ্বংসাত্মক মানসিকতার সঙ্গেই চলেছে অসম প্রতিযোগিতা। অসচেতনভাবে আমরা যে অস্বাস্থ্যকর ভোগবাদের বীজ নিভৃতে বপন করছি শিশুমনে, সেই বীজ নিত্যনতুন মহীরুহে পরিণত হতেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর থেকে পালিয়ে বাঁচার রাস্তাও যেন আর খুঁজে পাচ্ছিনা। কারণ চারপাশে লাখো লাখো ভুবন কিলবিল করছে। তুমি পালাবে কোথায়?
আজকের বাবা মা তাদের একমাত্র সন্তানটিকে অন্য ভাবে তৈরি করছেন। যেখানে দাদু-ঠাকুমা, জেঠ্যা-জেঠিমা, কাকা-কাকিমা, মাসি-পিসি, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ নেই। শুধু তিনজনের নিউক্লিয়ার পৃথিবী। বাবা-মা পাখি পড়ানোর মতো শেখাচ্ছেন, বান্টি সোনা, আমরাই শুধু আপনজন, বাকি সব জনগণ। ব্যাস, বাপ-মার চোখের আড়াল হতেই ছেলে তখন বেপরোয়া। সমাজকে ভয় পাবে কেন সে? ওরা কি তাকে খাওয়ায় না পরায়?
তাই তাদের আর কারও কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয় না। ফলস্বরূপ, বিপথগামিতা। নীতি ও মূল্যবোধহীন কুশিক্ষায় শিক্ষিত এরা সহজেই অপরাধপ্রবণ এবং মাদকাসক্তির কবলে পড়ে। কিন্তু বাবা-মায়ের কানে এই ভয়ঙ্কর খবরটি জনগণ পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। কারণ এখানে তাদের কোনও দায় নেই। যখন সন্তানের এই দুরবস্থার কথা অভিভাবক জানতে পারেন, তখন আর কিছুই করার থাকে না। তাদের দুচোখে শুধুই গাঢ় অন্ধকার।
৩০-৪০ বছর আগেও আমরা এক সামাজিক শাসন বা ঘেরাটোপের মধ্যে বড় হয়েছি। যেখানে সর্বদা থাকত পাড়াতুতো জ্যাঠা, কাকা, দাদাদের রক্তচক্ষু। তাই বখে যাওয়ার ভয় থাকতো অনেক কম। রক্ষণশীলতা এবং উদারতার মেলবন্ধনের বাতাবরণের মধ্যেই পারিবারিক ও সামাজিক শাসনে চরিত্র গঠন হত। শিক্ষক নির্দ্বিধায় শাসন করতে পারতেন। গণপিটুনির ভয় তঁাদের ছিল না। অনেকের মাঝে থেকে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মানসিক অবসাদ এবং একাকীত্ববোধ আসতো না। প্রকাশ্যে ডাং-গুলি খেলা ফেলে এখন নির্জনের স্কিন টাচ্। এতোটাই পরিবর্তন এসেছে একদা আমাদের আনন্দের ছোটবেলার জীবনে।
তাহলে উপায়? সমাধান তো ১৫০ বছর আগে বিদ্যাসাগর মহাশয় ভুবনের মুখ দিয়ে বলেছেন। প্রথম দিনের শাসন, শুধু শাসন। সঙ্গে বোঝানো অর্থাৎ কাউন্সেলিং। পরিবারের সাথে সাথেই সামাজিক শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। সমাজকে গা বাঁচিয়ে চললে হবে না। শিক্ষকের ভয় পেলে চলবে না। পাড়াতুতো সম্পর্কগুলো মজবুত ও গ্রহণযোগ্য করে সেই সম্পর্ককে দায়িত্বশীল করতে হবে। যাতে ছোট্ট ছেলে মেয়েরা জানতে পারে, তার ওপর লাখো চক্ষু নজর রাখছে।
বাবা-মাকেও অনেক বেশি সচেতন, চিন্তাশীল এবং পারদর্শী হয়ে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, পিঠে দু-একটা চাপ্পড় বা কানমোলা খেয়ে যদি তার ছেলে-মেয়ের চরিত্র গঠন হয়, সে ভুবন হওয়া থেকে রক্ষা পায়, তবে ক্ষতি কী! ছেলেটিও বাঁচবে আর সমাজও কলুষমুক্ত হবে। তখন আমরাও শান্তিতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারব।
আর যদি তা না করেন, জেনে রাখুন এই ভুবনেরা একসময়ে অভিভাবক থেকে শিক্ষক ও সমাজকর্তাদের কান কামড়ে প্রশ্ন করবেই, প্রথম দিনেই কেন ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে শাসন করনি? তখন মাসিরা কান বাঁচাতে পারবেন তো?