অতনুকুমার মাহিন্দার (প্রতিবেদক): স্বপ্ন, সাধনা, সিদ্ধি- এই তিনটি শব্দ এখানে পাশাপাশি থাকলেও, এদের মধ্যে ব্যবধান কিন্তু অনন্ত। এই পরস্পর দূরত্ব অতিক্রম করতে শক্তি, সাহস এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়। সেই ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায় আমাদের সকলের মধ্যে থাকে না। কিন্তু যাঁদের থাকে, তাঁরাই মানব সভ্যতার কাছে দৃষ্টান্ত এবং প্রণম্য হয়ে উঠেন। তাঁদের সেই আদর্শকে অনুসরণ করে পরবর্তী প্রজন্ম আবার শুরু করে স্বপ্ন দেখা, পথ চলা।
কৈশোরে এমনই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল খাসবাড় শ্রীমন্তপুর গ্রামের নিম্নবিত্ত রায় পরিবারের জিতেন্দ্রর চোখে। তাঁর স্বপ্ন থেকে সিদ্ধি লাভের পূর্ণপ্রাপ্তিতে, দাদা বীরেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল প্রকৃত অর্থে দীক্ষাগুরুর সমতুল্য। গ্রামের পাঠশালার প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র, ছোটভাই জিতেন্দ্রকে ডাক্তারি পড়ার জন্য গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেন। পিতা পূর্ণচন্দ্র গ্রামেই ছোট্ট মুদিখানার দোকান চালাতেন। তাই ডাক্তারি পড়ানোর মত সামর্থ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু বীরেন্দ্রর জেদ আর জিতেন্দ্রর মেধা, দুইয়ের ফলশ্রুতিতে ইড়পালার হাইস্কুলে পাঠ শেষে, ১৯৬১ সালে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ বর্তমানের চিত্তরঞ্জন থেকে ডাক্তারি পাস করেন জিতেন্দ্র। দীর্ঘ সাধনার সিদ্ধি প্রাপ্তি হয় তাঁর। ঘাটাল শহরে আসেন ১৯৬৩ সালে। থাকতেন শিলাবতীর পূর্ব পাড়ের এক ভাড়া বাড়িতে।
শ্রীমন্তপুর গ্রামের সেই ছেলেটির, ডাক্তার জিতেন্দ্রনাথ রায় হয়ে ওঠা খুব মসৃণ ছিল না। জটিল এক সমীকরণের মধ্য দিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন। ঘাত-প্রতিঘাতে প্রবল ছিল ব্যক্তি ও পেশাসত্তার টানাপোড়েন। সেক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন, ডাক্তারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব, কর্তব্য এবং মানবিকতাকে। তাই দিনের পর দিন গভীর রাতের সুখশয্যা ত্যাগ করে, ছুটে গেছেন রোগির আর্তচিৎকারে। অনেক সময়ই বাড়ি ফিরে এসেছেন ভোররাতে। রাত জাগা লাল চোখে ডাক্তার স্বামীর প্রতীক্ষায় থেকেছেন সহধর্মিণী মমতা। কিন্তু কোনওদিন অনুযোগ করেননি, করেননি অভিমান।
এম.বি.বি.এস পাস করে ন্যাশনাল মেডিক্যালে নিয়মমাফিক প্র্যাক্টিসের সময় পরিচয় হয় ওই হাসপাতালের নার্স মমতাদেবীর সাথে। পিতৃসূত্রে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শিলিগুড়ির বাসিন্দা মমতাদেবীর সঙ্গে ১৯৬৩তে পরিণয়ে আবদ্ধ হন ডাক্তারবাবু। তাঁদের এই পঞ্চান্ন বছরের দাম্পত্যজীবন, আজকের যেকোনও দম্পতির কাছে আক্ষরিক অর্থেই ঈর্ষণীয়।
তিন সন্তানের জনক ডাক্তারবাবু, তাঁর কনিষ্ঠপুত্র কলকাতা পুলিসের অফিসার সুদীপ্তকে হারিয়েছেন ২৬ আগস্ট, ২০১৪তে। কালান্তক ব্যাধি ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে তাকে। গভীর শোকে পুত্রহারা পিতার হৃদয় ভেঙে গেলেও, চেম্বার বন্ধ থাকেনি। বুক ফাটলেও বাইরে প্রকাশ পায়নি তা। শুধু নিভৃতে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, আমার একটা হাত ভেঙে গেল মিতা।
[quote style=’1′ cite=”]অন্তিম যাত্রায় অংশ নিতে আড়গোড়ার রাস্তায় তখন লোকারণ্য। সমাজসেবী উদয় সিংহরায়ের কর্মতৎপরতায় সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। পাশেই থেকেছেন যোগদা সৎসঙ্গ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরিশঙ্কর বাগ ও অন্যান্য অনেকেই। শেষবারের মত ডাক্তার স্বামীর বুকে আছড়ে পড়লেন মমতাদেবী। তীব্র কান্নায় আঁকড়ে ধরলেন তিনি। হঠাৎ যেন শুনতে পেলেন ডাক্তারবাবু বলছেন, মিতা শুনছো, আমি কিন্তু এখনও ঘুমোইনি…।[/quote]
নেশা বা হবি বলতে ছিল রোগির চিকিৎসা। তাই রাজ্যের বাইরে পা রাখেননি। ভ্রমণেও যাওয়া হয়নি কোনওদিন। স্ত্রী ও সন্তানদের মৃদু অভিমান আঁচ করলেও, পেসেন্টকে অসহায় অবস্থায় ফেলতে চাননি তিনি। আত্ম ও পারিবারিক সুখ বিসর্জন দেওয়ার এমন উদাহরণ দৃষ্টান্ত বৈকি! জীবনের শেষ রাতেও দুটি মোবাইল অন্ ছিল বালিশের পাশে। যদি কারও ডাক আসে…।
শুধু ডাক্তারি পেশার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গেই নয়, তিনি শহরের অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বিভিন্ন স্কুলের পরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত থেকেছেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন ঘাটাল যোগদা সৎসঙ্গ হাইস্কুলের। আজীবন কংগ্রেসি এই মানুষটি বহু আবেদন সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতিতে নামেননি। তাই সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে শ্রদ্ধেয়, গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রকৃতঅর্থেই অজাতশত্রু। সদাহাস্যময়, সুদর্শন, সুপুরুষ জিতেনবাবু রোগির নাড়ি টিপলেই, রোগির মনে হত যেন সমস্ত ব্যাধি উধাও হয়ে গেল তার। শহরের মানুষ জিতেনবাবুকে বলতেন, ‘ঘাটালের বিধান রায়।’
আফশোস তো ছিলই, তিন সন্তানের জনক হয়েও কাউকে ডাক্তার করতে পারেননি। তাই বড় ছেলে সঞ্জীবের পুত্র অর্কের অল ইন্ডিয়া নিটের পরীক্ষায় ২১৬ স্থান পাওয়ায়, শিশুর মত লাফিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। অর্ক এখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠরত। তাই বৃদ্ধ বয়সেও আবারও এক নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল তাঁর।
৩০ জুলাই, ১৯৩৬ জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রীমন্তপুর গ্রাম থেকে জিতেন্দ্রনাথ রায়ের যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, তা ১৪ অক্টোবর ২০১৮-র দুর্গাষষ্ঠীর রাতে ১১টা ৪০ মিনিটে হঠাৎ ফুরিয়ে যায়। সেই দূর্লভ মুহূর্তে মানবসাধক জিতেনবাবুর সান্নিধ্যে ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয় বান্ধবী, পত্নী, পঞ্চান্ন বছরের নিত্যসঙ্গীনি মমতাদেবী। মৃত্যুকালীন সময়ে পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিরা সকলেই ছিল কলকাতায়।
১৪ অক্টোবর রবিবার বিকেলে যথারীতি রোগি দেখেছেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ থেকে ৯টা পর্যন্ত টিভিতে জনপ্রিয় তিনটি সিরিয়ালও দেখেন তিনি। তারপর রুটিন ব্যায়াম করেন। পরে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পুত্র সঞ্জীব, কন্যা পাপিয়া, পুত্রবধূ বর্ণালি এবং ভাইপোদের সাথেও ফোনে খোঁজখবর নেন। একমাত্র কন্যা পাপিয়াকে দুর্গাপুজোয় নিমন্ত্রণ জানান।
১১টা ৩০ নাগাদ স্ত্রীকে রাতের খাবার দিতে বলেন। তিনি তখন আধশোয়া অবস্থায় বিছানায়। মমতাদেবী পাশেই ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি দিচ্ছিলেন। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ডাক্তারবাবুর গলায় এক অস্ফুট গোঁঙানির আওয়াজ শুনে মমতাদেবী তাকিয়ে দেখেন, স্বামীর ঠোঁটদুটি কাঁপছে। কিছু কী বলতে চাইছেন?
পরদিন সকালে একমাত্র কন্যা পাপিয়া পিতৃগৃহে এল ঠিকই, কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর লিখনে বদলে গেল উপলক্ষ্য, পাল্টে গেল প্রেক্ষাপট। মেয়েকে নিজ গৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েও নির্মম পরিহাসে পিতা স্বয়ং চলে গেলেন বহুদূরের কোনও অজানা গৃহে।
অন্তিম যাত্রায় অংশ নিতে আড়গোড়ার রাস্তায় তখন লোকারণ্য। সমাজসেবী উদয় সিংহরায়ের কর্মতৎপরতায় সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। পাশেই থেকেছেন যোগদা সৎসঙ্গ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরিশঙ্কর বাগ ও অন্যান্য অনেকেই। শেষবারের মত ডাক্তার স্বামীর বুকে আছড়ে পড়লেন মমতাদেবী। তীব্র কান্নায় আঁকড়ে ধরলেন তিনি। হঠাৎ যেন শুনতে পেলেন ডাক্তারবাবু বলছেন, মিতা শুনছো, আমি কিন্তু এখনও ঘুমোইনি…।
অতনুকুমার মাহিন্দার। ঘাটাল শহরে বাড়ি। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও অতনুবাবুকে সারা মহকুমার সাহিত্যপ্রেমী মানুষ অন্যতম সেরা প্রতিবেদক হিসেবেই চেনেন। এই লেখা সম্বন্ধে মতামত থাকলে অতনুবাবুকে সরাসরি জানাতে পারেন। অতনুবাবুর ফোন নম্বর:+91 78724 39449