সৌমেন মিশ্র, ‘স্থানীয় সংবাদ’, ঘাটাল: ১০১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন দাসপুর ছাড়িয়ে সারা দেশের গর্ব, বৌদ্ধচর্চার অন্যতম পণ্ডিত সুনীতিকুমার পাঠক। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ব্যক্তিত্ব বুধবার রাত দশটায় শান্তিনিকেতনে অবনপল্লীতে নিজ বাসভবনেই প্রয়াত হন। দাসপুরের রাজনগরের মানুষ ছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। সুনীতিকুমার পাঠক এবং মহিতোষ পাঠক, এরা দুই ভাই ছিলেন।
বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে গভীর চর্চা তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে। পায়ে হেঁটে হেঁটেই সংগ্রহ করে এনেছিলেন বহু দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান পুঁথি। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে সুনীতিকুমারের উদ্যোগেই ১৯৫৪ সালে শুরু হয়েছিল ভারত-তিব্বতী চর্চা (ইন্দো-টিবেটান স্টাডিজ)। বহুমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিজের বাসগৃহে। পুঁথির পাশাপাশি তাঁর জন্যই সাফল্য পেয়েছিল ওইসব অঞ্চলের ভাষাসংগ্রহের কাজ।
১৯২৪ সালের ১ মে তাঁর জন্ম। ছোটবেলায় মাকে হারান সুনীতি। এরপর মামাবাড়িতে বড় হয়ে ওঠা। প্রথমে সংস্কৃত কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন সুনীতি। ছাত্রবৃত্তি পেয়ে তিব্বতী ভাষাশিক্ষায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এরপর ১৯৫৪ সালে ২০৫ টাকা বেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি বিভাগে যোগদান করেন সুনীতিকুমার পাঠক। ওই বছরেই অধ্যাপক সি আর লামা ও তিনি যৌথভাবে শুরু করেন ভারত-তিব্বতী চর্চার (ইন্দো-টিবেটান স্টাডিজ) নতুন বিভাগ। তবে অধ্যাপনার পাশাপাশি শেখার মানসিকতাকে কখনও ত্যাগ করেননি সুনীতিবাবু। তাই ভর্তি হয়েছিলেন চিনাভবনে চিনা ভাষা শিক্ষার জন্য।
শতবর্ষ পেরিয়েও ভাষাচর্চা নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন সুনীতিকুমার পাঠক। ১০০ বছর বয়সেও গবেষণার নেশা তাঁর পিছু ছাড়েনি। ২০০৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত করেন। ২০১৮ সালে বিশ্বভারতী দেশিকোত্তমে সম্মানিত করে তাঁকে। এছাড়াও, এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মাননাতেও ভূষিত হয়েছেন সুনীতিবাবু। পেয়েছেন সুত্তবিশারদ স্বর্ণপদক ও পুরাণরত্ন স্বর্ণপদক।
গবেষণার পাশাপাশি নিজের লব্ধ জ্ঞানকে দেশসেবার কাজেও লাগিয়েছিলেন সুনীতিকুমার পাঠক। ১৯৬১ সালে ভারত সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনীতে অনুবাদক হিসেবে যোগ দেন। তিব্বতী ভাষার বিভিন্ন তথ্য সেনাবাহিনীর জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজে নিযুক্ত হন। গবেষণার পাশাপাশি এই প্রতিভা ভাস্বর করেছেন বৌদ্ধচর্চার ক্ষেত্রেও। দুশোর বেশি প্রবন্ধ ছাড়াও বহু গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন নিবন্ধের রচয়িতা তিনি। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, তিব্বতী, চিনা, মঙ্গোলিয়া—এই নটি ভাষাতেই তিনি সাবলীল ছিলেন। প্রতি ভাষাতেই নিজের লেখকসত্তার পরিচয় রেখে গিয়েছেন।