‘দুর্গাদেবীর সন্ধিপুজোতে ১০৮ টি পদ্ম কেন দিতে হয়?’ —উমাশংকর নিয়োগী
•শরৎ কালে মা দুর্গার সন্ধিপুজোর সময় ১০৮ পদ্ম দেবীরর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়ে থাকে । এত ফুল থাকতে পদ্ম কেন? কেনই বা ১০৮ টি ?
মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাহিনি অনুসারে দেবী চণ্ডিকা চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করার জন্য দেবী দুর্গার ভিন্নরূপ চামুণ্ডাকে প্রেরণ করেন । দীর্ঘ সংগ্রাম অন্তে অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে দেবী কালিকা চামুণ্ডা রূপে সমরকুশল চণ্ড ও মুণ্ড নামের দুই কুখ্যাত অসুরকে বধ করে তাদের কাটা মুণ্ড নিয়ে গিয়ে দেবী চণ্ডিকাকে উপহার দিলেন । চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয়ের কাটা মুণ্ড দেখে দেবী চণ্ডিকা মহা খুশি হয়ে বলে উঠলেন , হে দেবি ! চণ্ড ও মুণ্ডের কাটা মুণ্ড আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য এখন থেকে সকলের কাছে তুমি চামুণ্ডা নামে খ্যাত হবে । “ যস্মাচ্চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতা। চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি ।। “ এদিকে যুদ্ধ চলার সময়ে চণ্ড ও মুণ্ডের অস্ত্র শস্ত্রের আঘাতে দেবী দেহেও ১০৮ টি ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে গেল । যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতগুলিতে পচন ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেবীকে ক্রমাগত কাতর করে তুলতে লাগল । কালিকার এহেন দুর্বিষহ কষ্ট দেখে , দেবাদিদেব মহাদেব দেবীকে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে ,দেবীদহে স্নান করার পরামর্শ দিলেন ।
মহেশ্বরের পরামর্শ মেনে সাত তাড়াতাড়ি দেবীদহে স্নান করলেন দেবী । ১০৮ টি ক্ষতের ১০৭ টি তৎক্ষণাৎ শরীর থেকে মিলিয়ে গেল । শস্ত্রাঘাতের বিষজ্বালা থেকে অব্যাহতি পেলেন তিনি । আর দেবীদহে ফুটে উঠল ১০৭ট পদ্ম । দেবাদিদেব অন্তরীক্ষে থেক সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিলেন । শরীরে থেকে যাওয়া ক্ষতটির যন্ত্রণা দেবীকে বিব্রত করতে থাকল । এসব দেখে শুনে কালিকার ব্যথায় ব্যথাতুর হয়ে পড়লেন মহেশ্বর । তাঁর চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রু নির্গত হয়ে পড়ল দেবীদহের জলে । ফুটল উঠল আরো একটি পদ্ম । দেবীর ক্ষত গেল মুহূর্তে ভালো হয়ে , যন্ত্রণা মুক্ত হলেন তিনি ।
সৌন্দর্যে , গন্ধে পদ্ম বাংলার পারিজাত । বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ এই ফুলটির জন্ম পাঁকে । আর বাংলাদেশ পুকুর ,বিল, জলাশয়ে ভরা । গ্রীষ্মের অবসানে বর্ষা নামে । জলাশয় ভরে জলে । শীতে ঘুমিয়ে থাকা পদ্মের ঘুম ভাঙে । পদ্মের পাতায় ফুলে ভরে উঠে পুকুর , বিল , জলাশয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব । দেবী দুর্গার চরণে বাংলার মানুষ তার প্রিয় ফুল পদ্ম নিবেদন করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে । সে না হয় হল । কিন্তু দুটো পাঁচটা নয় একেবারে ১০৮ টা ! কেন ?
ভারতের দুই মহাকাব্য বাল্মীকি রচিত রামায়ণ ও বেদব্যাদ রচিত মহাভারত । রামায়ণ অনুবাদ করেছেন কৃত্তিবাস ওঝা , কাশীরাম দাস মহাভারত । মহাভারতের ভ্রাতৃবিদ্বেষ , যুদ্ধ বিগ্রহ অপেক্ষা রামায়ণের আদর্শ , পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলপুত্র , নির্লোভ, আপদে বিপদে পাশে থাকা ভাই , পতিব্রতা স্ত্রী , দুষ্ট দমনকারী রাজা ইত্যাদি বাঙালির কাছে বেশি জনপ্রিয় , অধিক পঠিত ও চর্চিত। বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে রামচন্দ্রের দেবী দুর্গার অকাল বোধনের কোনো নামগন্ধও নেই । কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণ পাঁচালীতে রামচন্দ্রকে দিয়ে দেবী দুর্গার অকাল বোধন পুজো করিয়েছেন এবং সেখানে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ১০৮ টি পদ্মের জন্ম কাহিনির সদ্ব্যবহার করেছেন ।
রামায়ণের লংকাকাণ্ডে রাবণ বধের উদ্দেশ্যে রামচন্দ্র দেবী দুর্গার কৃপা পাওয়ার জন্য অকালবোধন দুর্গাপুজো করলেন । কিন্তু দেবী পুজোতে সন্তুষ্ট হলেন না । রামচন্দ্র লঙ্কা জয়ের ব্যাপারে হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়লে , “ কাতর হইয়া তবে কন বিভীষণ । এক কর্ম্ম কর প্রভু নিস্তার কারণ ।। তুষিতে চণ্ডীর মন করহ বিধান । অষ্টোত্তরশত নীলোৎপল কর দান ।। কিন্তু এই নীলপদ্ম “ দেবের দুর্ল্লভ পুষ্প যথা তথা নাই । “ ঠিক হল রামভক্ত হনুমান পদ্ম আনতে যাবেন । পাওয়া যাবে কোথায় ? সুলুক সন্ধান জানতেন বিভীষণ “ বিভীষণ কন বীর হনুমান কাছে । অবনীতে দেবীদহে নীলপদ্ম আছে । “ হনুমান এক বছরের পথ একদিনে গিয়ে দেবীদহ থেকে গুণেগুণে ১০৮ টি পদ্ম তুলে নিয়ে রামচন্দ্রকে দিলেন । কিন্তু পুজোর সময় দেখা গেল ১০৭ টি আছে । পুজো বিফল হয় দেখে কমললোচন রামচন্দ্র খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন “ ভাবিতে ভাবিতে রাম করিলেন মনে । নীল-কমলাক্ষ মোরে বলে সর্ব্বজনে ।। যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোৎপল । সঙ্কল্প করিব পূর্ণ বুঝিবে সকল ।। ** এক চক্ষু দিব আমি সঙ্কল্প পূরণে । । এত বলি তূণ হৈতে লইলেন বাণ । উপাড়িতে যান চক্ষু করিতে প্রদান ।।‘ এসব দেখে মহামায়া নিজে আবির্ভূতা হলেন রামচন্দ্রকে রাবণ জয়ের নিমিত্ত আশীর্বাদ করলেন । সব তো হল একটি পদ্ম গেল কোথায় ?
আমরা আগেই জেনেছি শিবঠাকুরের চোখের জলে একটি পদ্মের জন্ম । ভোলা মহেশ্বরের চোখের জলে ফোটা ফুল দেবী নিজের পায়ে নেন কীকরে ! শিবঠাকুর ভিখিরি ঠিকই , তবু স্বামী তো? নাকি ! তাই তিনি হনুমানের আনা ১০৮ টি পদ্মের মধ্য থেকে চোখের জলে ফোটা ফুলটি নিজের হাতে সরিয়ে রেখেছিলেন । তাছাড়া শাস্ত্রকারেরা অন্যান্য ফুল পায়ে দিলেও পদ্মফুল দেবদেবীর মাথায় দিতে বলেছেন । “ সর্বং পুষ্পং তনৌ দদ্যাৎ পঙ্কজং শিরসোপরি । ”