‘তিয়রবেড়িয়া ৮০ মণ পেতলের রথযাত্রাঃ এক অনন্য লোক উৎসব’ —পম্পা ভূঞ্যা 

‘তিয়রবেড়িয়া ৮০ মণ পেতলের রথযাত্রাঃ এক অনন্য লোক উৎসব’ —পম্পা ভূঞ্যা 
♦জনপ্রিয় সংস্কৃতির আঞ্চলিক উৎস ও স্থানীয় পরিসর থাকে। পূর্ব ভারত ও উড়িষ্যায় রথযাত্রা একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় উৎসব ; রথযাত্রা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ভাবে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও রীতিনীতি নিয়ে বহমান। এইরকমই একটি দৃষ্টান্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ১ নং ও ২ নং ব্লকের অন্তর্গত তিয়রবেড়িয়ার ৮০ মণ পেতলের রথযাত্রা উৎসব।।
বিশ শতকের প্রথমভাগে অখন্ড মেদিনীপুরের মালিদা গ্রামের (বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা)  জমিদার  ত্রৈলোক্যনাথ সামন্তের তিয়রবেড়িয়া গ্রামের সম্পন্ন বাসিন্দা হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল । গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে জানা গিয়েছে  যে  বংশগতভাবে ত্রৈলোক্যনাথের তিয়রবেড়িয়াতে কোন  জমিদারির স্বত্ব ছিল না। মৌখিক তথ্যানুযায়ী জনৈক বলরাম সামন্ত পরিযায়ীর ন্যায় কাজের সন্ধানে তিয়রবেড়িয়া নামক গ্রামে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রাথমিক পর্বে  পাতা কেটে (কলাপাতা, দুর্বাঘাস যা বাজারে বিক্রয়যোগ্য) জীবিকা নির্বাহ করতেন। রঙ্গলাল সামন্তের ( স্বর্গীয় ত্রৈলোক্যনাথের পৌত্র) বক্তব্য অনুযায়ী বলরাম সামন্তের দুজন স্ত্রী ছিল। প্রথম পক্ষের পুত্র সন্তান হলেন ভগীরথ সামন্ত এবং দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র সন্তান হলেন ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত ও রমানাথ সামন্ত। পারিবারিক আর্থিক অভাব মোচনের জন্য ত্রৈলোক্যনাথ ও রমানাথ কলিকাতার বড়ো বাজারে ঝাড়াই মশলার ব্যবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে সামন্ত পরিবার ব্যবসায় উন্নতি লাভ করে এবং আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন করে। সেকালে বিত্তশালী হলে মানুষ ভূসম্পত্তি কেনার জন্য উদ্যোগী হতো, কারণ সামাজিক মর্যাদার নির্ধারক ছিল জমি বা ভূমি।  দাসপুরের তিয়রবেড়িয়া গ্রামে ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে ত্রৈলক্যনাথ বিত্তশালী হিসেবে সমাজে মর্যাদার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।  কলিকাতায় ব্যবসায়িক সূত্রে জীবনযাপনের কারণে সম্ভ্রান্ত আদব কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন ত্রৈলক্যনাথের পরিবার। এমতাবস্থায় ত্রৈলোক্যনাথের সিদ্ধান্তে নিজ গ্রামে কোন একটি লোক উৎসবকে কেন্দ্র করে নিজেদের পারিবারিক পরিচিতি ও খ্যাতি আরো বিস্তৃত করার কথা ভাবেন।  সামন্ত পরিবারের বর্তমান  সদস্য সুমন সামন্তের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে  আনুমানিক বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিয়রবেড়িয়া গ্রামের অধিবাসী গোষ্ঠ চক্রবর্তী নামক একজন ব্রাহ্মণ মদনগোপালরূপী কৃষ্ণের মূর্তির  আর্থিক অনটনের কারণে নিত্যদিনের সেবা দিতে অপারগ হয়েছিলেন।  এমতাবস্থায় তিনি এই মূর্তি বিক্রয় করেন জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ সামন্তের কাছে। সেই সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই সামন্ত পরিবারের কুলব্রাহ্মণ হিসেবে দায়িত্ব সামলে এসেছেন এই চক্রবর্তী পরিবার। যদিও মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে  তিয়রবেড়িয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম আড়খানার শিব পুকুর সংলগ্ন জমি ক্রয় করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে বাড়ি থেকে দূরত্বের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে  ত্রৈলোক্যনাথ তিয়রবেড়িয়াতেই কৃষ্ণরূপী মদনগোপাল জিউর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন,  এবং এখান থেকেই রথ উৎসবের শুভ সূচনা হয়।
আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়া শুক্লপক্ষে রথযাত্রার উৎসব শুরু হয় এবং নয়দিন ব্যাপী এই উৎসব চলতে থাকে। পাঁচটি চূড়াযুক্ত এই রথের উচ্চতা প্রায় ২৫-২৬ ফুটের কাছাকাছি, রথের চারকোণে চারটি মন্দিরে  চারজন ঋষি আর একেবারে মাঝে রত্না বেদীতে বিরাজ করেন সামন্ত পরিবারের কুলদেবতা মদন গোপাল জিউ এবং রাধারানীর বিগ্রহ; উল্লেখ্য যে  ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত পরবর্তীতে রাধারানীর বিগ্রহ টিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রথের চূড়ার মাথায় রয়েছেন বিষ্ণুবাহন গরুড়দেব এজন্য এই রথের নাম রাখা হয় ‘গরুড়ধ্বজ’। রথের একেবারে সামনের দিকে ঘোড়া এবং সারথি সাত্যকি আর চূড়াতে রয়েছে লাল রঙের পাঁচটি ধ্বজা। রথের আগের দিন হয় নেত্র উৎসব ( রথকে পরিষ্কার করে সাজানো হয়) এবং নয়দিনের দিন ফিরতি রথ বা উল্টো রথ টানার মধ্যে দিয়ে রথযাত্রার শুভ সমাপ্তি ঘটে। সামন্ত পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য অনুযায়ী ত্রৈলোক্যনাথ কাঠের পরিবর্তে গ্রামীণ উৎপবে এক অনন্য মাত্রা সৃষ্টির জন্য কলিকাতা থেকে  নৌকার মাধ্যমে রূপনারায়ণ ও দুর্বাচটি নদী হয়ে তিয়রবেড়িয়া গ্রামে পেতল আনা হয়। সেকালের পেতলের তৈরি এই রথের বিভিন্ন জায়গায় এখনো  ব্রিটিশ সরকারের স্ট্যাম্প লক্ষ্য করা যায়।
রথযাত্রা উৎসবের প্রথমদিকে খুব বড়ো করে মেলা হতো না, কিন্তু উৎসবের কিছু বছর পর থেকেই নয়দিন উৎসবের মধ্যে দুদিন ব্যাপী প্রীতিভোজের আয়োজন করা হতো। যেখানে নিমন্ত্রিত থাকতেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ বহু কর্মচারী, এক্ষেত্রে গ্রামীণ অঞ্চল কর্মীরা বিশেষ উল্লেখযোগ্য এছাড়াও চৌকিদার, সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই নিমন্ত্রিত থাকতেন। এই নয়দিন ব্যাপী মেলার বিশেষ বিশেষত্ব হলো  পৌরাণিক কাহিনী ভিত্তিক পুতুল নাচ। মূলত সামন্ত পরিবারের মহিলারা সরাসরি রথতলায় পুতুল নাচ দেখতে যেতেন না, যে কারণে নয়দিনের মধ্যে একদিন সামন্ত পরিবারের বাস্তুভূমির ওপর গঠিত মা শীতলা দেবীর আটচালাতে এক পুতুল নাচ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদের জন্য অনুষ্ঠিত হতো। যদিওবা সাধারণ উচ্চ – নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারা সরাসরি রথতলায় গিয়ে পুতুল নাচ দেখতে পারতেন। এই মেলার আরেক বিশেষত্ব হলো তালপাতার পুতুল যা তালপাতার সেপাই নামে পরিচিত। এছাড়াও তালপাতার বাঁশি ( ভেঁপু) , তালপাতার পাখা সবথেকে বেশি পরিমাণে বিক্রয় হত এছাড়াও বাঁশ দিয়ে তৈরি চালা,কুলো,ধুচনি (চাল ইত্যাদি ধুইবার জন্য সরু করে বাঁশের তৈরি সচিদ্র পাত্র)বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত শিল্পের শিল্পীরা হলেন আড়খানা গ্রামের ডোম সম্প্রদায়।  এগুলোই ডোম সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম। প্রযুক্তি নির্ভর জীবনে এগুলি লুপ্তপ্রায়।  পার্শ্ববর্তী বহু গ্রামের ছেলে – মেয়েরা মেলা শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই কাজের ঠোঙা তৈরির কাজ শুরু করে দিত যা ২০ বা ২৫ পয়সা কেজিতে বিক্রি করতো।আজ থেকে আনুমানিক ৪০ বছর পূর্বে এক পয়সায় একটা ফুলুরি, পাঁচ পয়সায় দুটো পেঁয়াজি, পনেরো পয়সায় একটা চপ পাওয়া যেতো, তালপাতা ,  কলাপাতার টুকরো তে বিক্রি হওয়া ঘুগনির জায়গা নিয়েছে  থার্মোকলের বাটি।
সমাজ অগ্রগতির সূত্র ধরে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটছে, ফলতঃ মানুষের জীবনের আনন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত লোক উৎসবের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন ঘটছে। এক্ষেত্রে এই রথ যাত্রা উৎসব তার ব্যতিক্রম নয় । তালপাতার জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিক, পুতুল নাচও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সময়ের দাবিতে যেমন ভালো কিছুর বিলুপ্তি ঘটছে, তেমনি ভালো কিছুর সূচনা বর্তমানে মেলার মূল আকর্ষণ “নার্সারি ” নানান প্রজাতির গাছের সমারোহ, যা পরিবেশ সবুজায়নে ভূমিকা পালন করছে তিয়রবেড়িয়া সহ তার পাশ্ববর্তী গ্রাম গুলিতে, স্থানীয় গ্রামীণ শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা প্রস্ফুটিত করতে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন (যেমন কবিতা পাঠ, নৃত্য পরিবেশন, যেমন খুশি তেমন সাজো, মনসংযোগ কে ভিত্তি করে জল ডাঙ্গা আয়োজন করা হয়) ।  এই মেলাতে হিন্দু সামাজিক কাঠামোতে যারা অন্তজ তারাও মোয়া তৈরি করে, রথের রসি টানে  ও উৎসবে সামগ্রিক ভাবে যোগদান করেন , তাই মেলা সামাজিক সম্প্রতির উদাহরণ।। [লেখক ইতিহাস বিভাগ, মেদিনীপুর কলেজ ( স্বশাসিত) থেকে সদ্য স্নাতক (২০২৪),বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকের অন্তর্নিহিত পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করতে আগ্রহী]
তথ্যসূত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগ্রহিত :-
১) শঙ্করী মালিক ( গ্রাম – রবিদাসপুর)
২) বাসুদেব ভূঞ্যা( গ্রাম রবিদাসপুর, গ্রামীণ চিকিৎসক)
৩) রঙ্গলাল সামন্ত ( গ্রাম তিয়রবেড়িয়া)
৪) সুমন সামন্ত( গ্রাম তিয়রবেড়িয়া, স্থানীয় সাংবাদিক )
 

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!