‘রথ’—উমা শঙ্কর নিয়োগী
হিন্দুদের একটি বড় উৎসব রথযাত্রা। মূলত পুরীর শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষে দেশবিদেশের লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা এবং শুক্লা দশমী তিথিতে পুনর্যাত্রা হয়। রথে চড়ে জগন্নাথদেব বৈমাত্রেয় ভাইবোন বলরাম এবং সুভদ্রা সহ গুণ্ডিচা বা মাসির বাড়ি যান সেখানে আট দিন থেকে ফেরতি রথে স্বস্থানে ফিরে আসেন। আসছি এসব কথায়। তার আগে রথ সম্পর্কে দু চার কথা জেনে নিতে পারা যেতে পারে।
রথের উল্লেখ আমাদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ সংহিতায় পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের ৬ ষ্ঠ মণ্ডলের ৪৭সূক্তের ২৪ সংখ্যক মন্ত্রটি,” দশ রথাৎ প্রষ্টিতমঃ শতং গো অথর্বভ্যঃ।অশ্বথঃ পায়বেঽদাৎ।।” ‘ অশ্বথ আমার ভ্রাতা পায়ুকে অশ্বগণের সাথে দশখানি রথ এবং অথর্ব গোত্র ঋষিগণকে একশত গো প্রদান করেছেন। ‘ ঐ মণ্ডলের ঐ সূক্তের ২৭ মন্ত্রে ” বজ্রং হবিষা রথং যজ। ।” ইত্যাদি উল্লেখ আছে। উপনিষদের বহু মন্ত্রে রথের উল্লেখ আছে। দেহের সঙ্গে রথের তুলনা করা হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীতে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে ফিরে এলে ব্রজগোপিনীরা তাঁকে রথে করে নিয়ে গিয়েছেন। রামায়ণে উন্নত রথ পুষ্পক রথে করে রাবণ সীতা হরণ করেছে। মহাভারতে ভীষ্মের অম্বা ,অম্বিকা আর অম্বালিকা হরণ , কৃষ্ণের রুক্মিণী হরণ, জয়দ্রথের দ্রৌপদী হরণ, অর্জুনের সুভদ্রা হরণ রথে করেই। তাছাড়া মহাভারতের যুদ্ধে রথের ছড়াছড়ি। ঐতিহাসিক ভাবে রথের উল্লেখ পাওয়া যায় ফা- হিয়েনের বর্ণনায়। ফা- হিয়েন ভারতে ভ্রমণ করেছেন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন রথে উপর বুদ্ধদেবের মূর্তি রেখে রথ টানার বিবরণ আছে। এখন থেকে পাঁচশ শ বছরের আগে ঐতিহাসিক পুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচলে থাকার সময়ে জগন্নাথদেবের রথ টানা হত। একজন জীবনীকার এই রথের সময় চৈতন্য মহাপ্রভু নৃত্য করতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে।
জগৎ এবং নাথ এই দুটি শব্দের মিলিত রূপ জগন্নাথ। জগৎ শব্দের বুৎপত্তি, গমন্ + ক্বিপ্। যা চলছে।জগতে কোন কিছুই স্থির নয়।সবই চলছে ।চলমান সমস্ত জগতের প্রভু আশ্রয় জগন্নাথ নীলমাধব দধিবামন। জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় কেবল বিষ্ণু ভক্তের সমাগম হয় তা নয়, সৌর শাক্ত শৈব গাণপত্য সবাই অংশ গ্রহণ করেন। সতীর নাভী পড়েছে পুরীতে। জগন্নাথ মন্দির চত্বরে দেবী বিমলার মন্দির। শাক্তরা একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ শ্রীক্ষেত্রের দেবী বিমলার ভৈরব হিসেবে জগন্নাথকে দেখেন।প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে কৃষ্ণের নাভী জগন্নাথদেবের দারু মূর্তির মধ্যে রেখে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। বহু পণ্ডিত রথযাত্রাকে কৃষি উৎসব বলেছেন। এটি আষাঢ় মাসে হয়। কৃষ্ণ গোপালক বলরাম হলধর সুভদ্রা বসুন্ধরা। অনেক মনে করেন নীলমাধব আদতে শবর তথা ব্যাধেদের দেবতা। শবররা বৃক্ষকে দেবতা হিসেবে পুজো করে। হাত পা হীন দারুব্রহ্ম আর্যীকৃত হয়ে জগন্নাথ। জরা ব্যাধ বা বিশ্ববসু জগন্নাথ দেবের প্রতিষ্ঠা করেন।পরে ইন্দ্রদ্যুম্নের আধিকারে যায়।
জগন্নাথ দেবের রথের নাম নান্দীঘোষ/ গরুড়ধ্বজ/কপিধ্বজ। এই রথের চাকা ষোলটি। প্রত্যেকটির বেড় সাত ফুট। রথের উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। মূল কাঠামোর দুশ ছটি কাঠ সহ মোট আটশো বত্রিশটি কাঠের টুকরো দিয়ে রথ তৈরি হয়। সামনে চারটি ঘোড়া থাকে। ঘোড়াগুলির নাম হরিদ্বাশ্ব শ্বেতা বলাহক এবং শঙ্খ। সারথির নাম দারুকা। লাল হলুদ কাপড়ে সজ্জিত করা হয় রথকে। এই রথের চূড়ায় ত্রৈলোক্যমোহিনী নামে পতাকা উড়ে।জগন্নাথের সঙ্গে থাকেন মদনমোহন। এছাড়া আরো নটি দেবতা থাকেন। এঁরা হলেন, গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নরসিংহ ,রাম ,নারায়ণ, হনুমান, রুদ্র ,বরাহ ও ত্রিবিক্রম। এই রথের একমাত্র রক্ষক গরুড়।রথের রশিটি দেড়শ ফুট লম্বা। রথের রশির নাম শঙ্খচূড় নাগিনী। রথ চলার সময়ে তিনটি চাকার দাগ পড়ে। এদের নাম গঙ্গা যমুনা সরস্বতী। অনেক বলেন ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্না। ষোলটি চাকা দশটি ইন্দ্রিয় ও ষড় রিপুর প্রতীক । দুশ ছটি মূল কাঠ মানব দেহের হাড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বলরামের রথের নাম তালধ্বজ।এর সাত ফুট পরিধির চাকা চোদ্দটি। চোদ্দটি চাকা চোদ্দ ভুবনের প্রতীক। রথের উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। পতাকার নাম উন্যানী।সাতশো তেষট্টিটি কাঠের টুকরো দিয়ে রথ তৈরি হয়। লাল ও সবুজ কাপড়ে সাজানো হয়। দেড়শো ফুট রথের রশির নাম বসুকিনাগ । রথের সারথি মাতলি। বলরামের সঙ্গে রথের উঠেন রামকৃষ্ণ। ইনি পাশেই থাকেন। এছাড়া রথে থাকেন কার্তিক,গণেশ ,সর্বমঙ্গলা,মৃত্যুঞ্জয়, মুক্তেশ্বর ,হলায়ুধ প্রলম্বরী শেষদেব ও নটেশ্বর।
সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন পদ্মধ্বজ বা দেবদলন। এর সাত ফুট পরিধির বারোটি চাকা ।বারো মাসের প্রতীক। রথের উচ্চতা তেতাল্লিশ ফুট। কাঠের টুকরো থাকে পাঁচশ তিরানব্বইটি। পতাকার নাম নদম্বিকা। লাল কালো কাপড়ে সাজানো থাকে। সুভদ্রার রথের সারথি অর্জুন। সুভদ্রার সঙ্গে রথে ওঠেন সুদর্শনা। এছাড়া রথে থাকেন চণ্ডী, চামুণ্ডা,বনদুর্গা,শুলিদুর্গা,শ্যামাকালী,মঙ্গলা,বিমলা,রমা ও জয়দুর্গা ।রথের রশির নাম স্বর্ণচূড়া নাগিনী।
রথে কোন নাট বল্টু স্ক্রু নেই। পুরুষানুক্রমে রথের তৈরি করেন বেশ কয়েকটি পরিবারের লোকজন। প্রতি বছর নতুন করে রথ তৈরি হয়। রথের শেষে কাঠগুলো জগন্নাথদেবের ভোগ রান্নার জ্বালানি হয়। কাঠ সংগ্রহ করা হয় দাশপাল্লা ও রানাপুর জঙ্গল থেকে । প্রতি বছর যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়ে তার দশগুণ গাছ লাগানো হয়। আগে বলরামের রথ মধ্যে সুভদ্রার আর শেষে থাকে জগন্নাথের রথ। বলরাম গুরু সুভদ্রা ভক্তি এবং জগন্নাথ পরমেশ্বরর প্রতীক। গুরুর কৃপা এবং ভক্তি যোগে ঈশ্বর লাভ হয়। জগন্নাথদেবের রথ চলে সবার স্পর্শে। সভ্যতার অগ্রগতিতে সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন রথযাত্রা তা বোঝানো হয়েছে। রথের মধ্যে দেহতত্ব লুকিয়ে আছে। দুর্ভাগ্য রথের দিন আমরা রথের রশিতে টান দি পরে এর উদ্দেশ্যে ভুলে যাই। কবে আমরা বলার সাথে সাথে উপলব্ধি করবো যে, ” ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।তেজস্বি নাবধীতমস্তু। মা বিদ্বিষাবহৈ।”
c উমাশঙ্কর নিয়োগী।