দেবাশিস কুইল্যা[অতিথি লেখক, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল]: কয়েক বছর পূর্বেই সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন] টিউশন পড়ানো যাবে না। নির্দেশিকার অনেকগুলি কারণের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী করা। ভাল উদ্যোগ। তবুও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষককে বিদ্যালয় সময়ের বাইরেও নির্দিষ্ট বিষয়ে কোচিং করাতে। যা টিউশন নামেই পরিচিত। বিদ্যালয় শিক্ষকদের টিউশন বন্ধের বারবার সরকারি বিজ্ঞপ্তি ও নিষেধ সত্ত্বেও অধিকাংশ বিদ্যালয় শিক্ষক নির্দ্বিধায়
উপেক্ষা করেন। শুধু উপেক্ষা নয়,স্কুল সময়ের বাইরে সকাল ও বিকেলে নিজ নিজ স্কুলেই টিউশন পড়ান, যা বিদ্যালয়ের সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের নামান্তর। এইসব শিক্ষককূল টিউশন পড়ানোর পেছনে যুক্তি উপস্থাপন করেন; পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সময়ের বাইরেও বেশি সময় দিচ্ছেন আর মেধাবী শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্ষুরধার করছেন। ভাল কথা! বর্তমান সময়ে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় টিউশন পড়ানোর মাধ্যমে নিজের ও পাশাপাশি বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রথম হওয়ার
কোচিং দেওয়ার পেছনে কী এমন কারণ লুকিয়ে আছে যা বিজ্ঞান ভিত্তিক বিদ্যালয় শ্রেণি শিক্ষার বাইরেও টিউশন পড়াতে হয়? এর পেছনে অপ্রকাশিত সত্য হল অর্থের বিনিময় আর অভিভাবকদেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন। অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে টিউশন পড়ানোর পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখেন,বিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই তাঁর (শিক্ষক) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীরতা প্রচুর আর বিষয়ের প্রতি তিনি উৎসর্গিত—এই বিশ্বাসে অভিভাবকেরা অর্থের কার্পণ্য করেননি উপযুক্ত গুরুদক্ষিণায়। বিদ্যালয় শিক্ষকের টিউশন পড়ানো শুধু উপযুক্ত গুরুদক্ষিণায় নয় নৈতিক মূল্যবোধহীনতারও একটা দিক। প্রাচীন ভারতের গুরুকূল শিক্ষায় পরামর্শদানের গুরুদক্ষিণা স্বরূপ শিক্ষার্থীদের মাধুকরীতে পাঠানো হতো যাতে জীবনের অজানা দিক সহজেই উন্মোচন করতে পারে শিক্ষার্থী। অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র তার মানবসম্পদ তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা করেছে। তারজন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিদ্যালয় শিক্ষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক বা দক্ষিণা দেয়। যা মাস মাইনে। বিদ্যালয় শিক্ষকের উপযুক্ত পরিমাণ গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে রাষ্ট্র বা সরকার চাইবে বিদ্যালয়ের মধ্যেই শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার চেষ্টায় বিচ্যুত না হন। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিদ্যালয় শিক্ষকদের মূল্যবোধের সাথে নৈতিক কর্তব্যবোধ।
বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয় বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না,অধিকাংশ বিদ্যালয় শিক্ষক (যারা টিউশন পড়ান) সরকার প্রদেয় অর্থের বাইরেও অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে মূল্যবোধ ও নৈতিক কর্তব্যবোধ বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত নন। এইসব শিক্ষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে অভিভাবকও কুন্ঠিত নন। কেননা,এক শ্রেণির অভিভাবকদের ধারণা বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় অতি সামান্যতম ভগ্নাংশের পার্থক্যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি না পাওয়া উপযুক্ত শিক্ষিত বেকারের বিষয়ে গভীরতা যে কম নয় বা বিদ্যালয় শিক্ষকের থেকেও যে কম জানেন না এই ধারণাই নেই। এই প্রবণতার কারনেই টিউশন পড়ানো বিদ্যালয় শিক্ষক নির্দ্বিধায় সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করার সমর্থন পান। এই সমর্থনের সুযোগে বর্তমান বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষয় ভিত্তিক প্রোজেক্টের নম্বর নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে টিউশন পড়া ছাত্রটির বিষয় ভিত্তিক নম্বর নির্ধারণ হয়। অভিভাবকদের ভাবনা ও প্রোজেক্ট নির্ভর বিষয়ে অতিরিক্ত নম্বর পাওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চান না জেনে বুঝে। এখানেই সূচিত হয় অবক্ষয়িত নৈতিক মূল্যবোধের সূচনা। এই অবক্ষয়িত মূল্যবোধের কারণেই অনেক ক্ষেত্রেই টিউশন না-পড়ানো শিক্ষক সমাজের সাথে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দ্বন্দ্বের বীজ বপন হয়। যার পূর্ণ সুযোগ নেয় টিউশন পড়ানো বিদ্যালয় শিক্ষক। টিউশন পড়ানো এই সব বিদ্যালয় শিক্ষক সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষার কারণ হিসেবে হাজারো যুক্তি খাড়া করেন। যেমন বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো, নিজস্ব সময় অতিবাহিত করার জন প্রিয় শিক্ষার্থীদের কিছুক্ষণের জন্য কাছে ডেকে নেওয়া। তার বিপরীতে থাকা মানুষটির বুঝতে অসুবিধা হয় না এগুলি টিউশন পড়ানো বিদ্যালয় শিক্ষকদের অপ্রকাশিত কিছু সত্যের অপলাপ। মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া শিক্ষক করুণার পাত্রে পরিণত হয়ে নিজস্ব বোধ হারিয়ে ফেলেন। এই অপ্রকাশিত মিথ্যার মধ্যেই নৈতিক শিক্ষাবিহীন মানুষের আত্মা প্রকট হয়। এইসব কারণেই সরকারি নির্দেশনা শুধু নির্দেশনা হিসেবে থেকেই যাবে ফাইলবন্দি হয়ে যতদিন না টিউশন পড়ানো বিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম নেয় আর অনেক দূরে থেকে যাবে,‘শিক্ষক’ শব্দের বর্ণগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিষ্টাচার,কর্তব্যবোধ আর ক্ষমাসহিষ্ণুর মতো বিষয়গুলির গভীর ও মর্মস্পর্শী অনুভব টিউশন পড়ানো বিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে।
বিদ্যালয় শিক্ষকদের টিউশন পড়ানো আইন করে বা শুধু সরকারি নির্দেশিকা জারি করে বন্ধ করা সম্ভব নয়। বিদ্যালয় শিক্ষকদের না পড়ানোর মানসিকতা তৈরির সাথে সাথে অভিভাবকদেরও উদ্যোগ নিতে হবে বিদ্যালয় শিক্ষকের কাছে নিজের সন্তানকে টিউশন না পড়ানোর। উভয়ের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয় শিক্ষকদের টিউশন পড়ানো বন্ধ হলে বিদ্যালয় পরিবেশ ও সমাজে অনেক ইতিবাচক লক্ষণ দেখা দেবে বলেই বিশ্বাস। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও সমমানসিকতার পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সুন্দর ও সৃজনশীল প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভগ্মাংশের পার্থক্যে চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত যুবকটিও পাশের বাড়ি বা পাড়ার ভাইবোনদের পাঠ্য বিষয়টা যত্মসহকারে জানানো বা দেখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের জন্য সামান্য আর্থিক সুরাহা করতে শুধু সক্ষম হবে না বিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতেও সাহায্য করবে, যা বিদ্যালয় ও তার চারপাশের পরিবেশ পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।