‘বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর পাল’— উমাশঙ্কর নিয়োগী

বিপ্লবী প্রভাংশু শেখর পাল — উমাশঙ্কর নিয়োগী
•ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের তীর্থ ভূমি ও স্বাধীনচেতা বহু বীরের জন্মভূমি এই মেদিনীপুর জেলা। দেশমাতৃকার সেবায় শত-শত বীরের আত্মোৎসর্গ রক্তে রাঙা লাল মাটির দেশ মেদিনীপুর। এই জেলার ঘাটাল মহকুমার স্বাধীনতা আন্দলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে দাসপুর থানার নাম অগ্রগণ্য। এই থানা শহিদ প্রদ্যোত ভট্টাচার্য, বিপ্লবী [‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]পূর্ণচন্দ্র সেন, মোহিনীমোহন দাস, মৃগেন্দ্র ভট্টাচার্য, ভবানীরঞ্জন পাঁজা, স্বদেশরঞ্জন দাস, মোহিনীমোহন মণ্ডল, হৃষীকেশ পাইন, মন্মথকুমার মুখোপাধ্যায়, কাননবিহারী গোস্বামী, বিনোদবিহারী বেরা প্রমুখের জন্মভূমি আবার শহিদ ক্ষুদিরাম বসু, বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়, বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর

পাল প্রমুখের স্মৃতি বিজড়িত এই দাসপুর।
ফাইলেরিয়া নিরাময়ের ওষুধ ‘রোস্ট বিএ’(ROST BA) আবিস্কারক খানজাপুরের ডাক্তার আশুতোষ পাল কর্মসূত্রে ওড়িশার পুরীতে থাকতেন। আশুতোষের পুত্র প্রভাংশুশেখর মা লক্ষ্মীমণির কোল আলো করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই শনিবার পুরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। আশুতোষের কর্মস্থল পুরী হলেও খানজাপুরের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। প্রভাংশুশেখর ওরফে জম্বু বহুবার পৈত্রিক বাসস্থান খানজাপুর এসেছেন বাবা মায়ের সঙ্গে। তাঁকে পড়াশোনা করার জন্য ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর শহরে মামা কৃষ্ণচন্দ্র বসুর বাড়িতে পাঠানো হয়। তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল

হিন্দু স্কুলে।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দেই মেদিনীপুর শহরে ‘মেদিনীপুর যুবসংগঠন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ত্রিপাঠী। এই সংগঠনের অন্যতম কাজ ছিল দেশ মাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে যুবকদের উৎসাহিত করা। এই বছরের মাঝামাঝি ঢাকা থেকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার দলের দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুরে ওকালতি করা দাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের কাছে এলেন। ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজে। দীনেশর প্রধান লক্ষ ছিল বি ভির সংগঠন মজবুত করে গড়ে তোলা। সাংগঠনিক দীনেশ অল্প দিনের মধ্যেই মেদিনীপুর শহর কেন্দ্রিক গুপ্ত সমিতির একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুললেন। সদস্য হলেন যতিজীবন ঘোস, ফণী কুণ্ডু, নির্মলজীবন ঘোষ, অনাথবন্ধু পাঁজা, প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য, প্রভাংশুশেখর পাল, বিমল

দাশগুপ্ত, ফণীন্দ্রকুমার দাস প্রমুখ। গুপ্ত সমিতির সকল সদস্য শপথ নিতেন মন্ত্রগুপ্তির। জীবন পণ করে দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে ইংরেজের শত প্রলোভনে ভোলা যাবে না, ফাঁসি, দ্বীপান্তর বা জেল হতে পারে দেশ মুক্তি চাইলে, চলতে পারে অবর্ণনীয় অত্যাচার সব সহ্য করতে হবে, মুখ খোলা চলবে না – এই ছিল মন্ত্রগুপ্তি।
মেদিনীপুর শহরে পাশাপাশি থাকতেন প্রদ্যোৎ আর প্রভাংশুশেখর। পরিচয় সমিতিতে। নিত্য দিন ভোরবেলা দুজনে শরীর চর্চা করতেন। চলত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। পড়তেন দেশ বিদেশের ইতিহাস। কংসাবতী নদীর ধারে জঙ্গলে চলত দীনেশের তদারকিতে অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষার পাঠ। ১৯৩১ খিস্ট্রাব্দে ৭ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে জেলা শাসক মিঃ পেডি নিহত হলেন। পেডির হত্যাকারী বিমল দাশগুপ্ত পালাতে সক্ষম হলেও দীনেশ গুপ্তের বিচারে ফাঁসি হয়ে গেল ৭ জুলাই। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর হিজলি জেলে নারকীয় ঘটনা ঘটে। মিঃ পেডির মৃত্যুর পরেই মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এলেন মিঃ রবার্ট ডগলাস। অত্যাচারী ডগলাসকে হত্যা করার জন্য আদর্শ বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর পাল ও প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপরে দায়িত্ব ন্যস্ত হয় কিন্তু প্রমথ টেনশন মুক্ত হতে পারছিলেন না বলে এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রদ্যোত ভট্টাচার্যকে নির্বাচিত করা হয়। পেডি হত্যার পরিকল্পনা কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর প্রভাংশু তাঁদের কলকাতার বলরাম দে স্ট্রিটের বাড়িতে চলে যান। ওখানে তাঁর মা লক্ষ্মীমণি অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত ছেলেদের সবরকমের সাহায্য করতেন।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ এপ্রিল মাস। বিপ্লবীদের কাছে খবর এল ৩০ শে এপ্রিল জেলা বোর্ডের মিটিঙে মিঃ রবার্ট ডগলাস থাকবেন। কলকাতায় সুপতি রায়ের কাছ থেকে প্রভাংশু ৩৮০ বোরের একটি পাঁচঘড়া রিভলবার এবং ২৩ টি বুলেট সংগ্রহ করে মেদিনীপুরে এসে ফণী দাসের কাছে রিভলবার ও ষাট টাকা জমা দিয়ে মামা অমলচন্দ্র বসুর বাড়িতে ওঠেন ২৯ এপ্রিল। ৩০ এপ্রিল শনিবার। অকুতোভয় দুই বীর সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ডগলাসের চেয়ারের পেছনে গিয়ে হাজির হন প্রভাংশুর রিভলবার নিমেষে পাঁচটি গুলি উগরে দেয়। যা ডগলাসের দেহ ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রদ্যোতের রিভলবার থেকে গুলি বের হয়নি। অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে পাল্টা গুলি ছুঁড়ে প্রভাংশু পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। প্রদ্যোত ধরা পড়ে যান। হাজার অত্যাচার করেও পুলিশ প্রদ্যোতের কাছ থেকে প্রভাংশুর নাম জানতে পারেনি। বিচারে প্রদ্যোতেকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়।
সন্দেহের বশে পুলিশ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ১১ মে প্রভাংশুকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে। কিন্তু জেলা বোর্ডের কোন মেম্বার তাঁকে আসামী বলে সনাক্ত করতে পারেননি, ফলে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর পুলিশ আবার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে আতকে রেখে নানা অকথ্য অত্যাচার চালায়। বিনা বিচারে তাঁকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি বহুদিন নজরবন্দিও ছিলেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে বি.কম. পাশ করার পর অকৃতদার প্রভাংশু হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করে প্র্যাকটিস করতেন আর বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেরিতে হলেও ১৯৭২খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত সরকার তাঁর দেশ প্রেমের জন্য তাম্রপত্র দিয়ে সম্মান জানায়। এই মহান বিপ্লবী ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন মঙ্গলবার পরলোক গমন করেন। ঘাটাল মহকুমার গর্ব বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর পাল এবং শহিদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য।[প্রতিবেদক দাসপুর-১ ব্লকের নন্দনপুর হাইস্কুলের বাংলা সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক]
আকর গ্রন্থ: অগ্নিযুগের দুই সৈনিক শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ও বিপ্লবী প্রভাংশুশেখর, সম্পাদনা ইরা ধর সুবল সামন্ত।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!