এই মুহূর্তে ক্রীড়া/অনুষ্ঠান অন্যান্য সাহিত্য সম্পাদকীয় নোটিশবোর্ড

‘নাড়াজোলের রামনবমীর রথ’ — উমাশঙ্কর নিয়োগী

Published on: April 19, 2021 । 2:48 PM

‘নাড়াজোলের রামনবমীর রথ’
উমাশঙ্কর নিয়োগী: এক সময়ে ঘাটাল মহকুমার  নাড়াজোলে রামনবমীর রথযাত্রা  উপলক্ষে বসা  জাত দাসপুর  থানা কেন ঘাটাল মহকুমার সব থেকে বড় জাত ছিল ।১২২৫ সালের (১৮১৯খ্রিস্টাব্দ)  চৈত্র মাসে  রাজা মোহনলাল খাঁন  রামনবমীর দিন রথযাত্রা  আরম্ভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে  ১৮১৮  খ্রিস্টাব্দে  লঙ্কাগড়ে জলহরি  নামক গ্রীষ্মাবাসটিও নির্মাণ করেন মোহনলাল খাঁন।  রাজবাড়ির  সামনে থেকে রথ টানা হয়ে লঙ্কাগড় পর্যন্ত  যায় এবং ঐ দিনই  ফিরে আসে । ফিরতি  রথ নেই। রথযাত্রা  রামচন্দ্রের লঙ্কা বিজয়ের  প্রতীক।
মহকুমার সব থেকে বড়  রথটি প্রজাসাধারণের টানে  চলতো বারোটি লোহার চাকার উপর ভর করে। বারো মাসের প্রতীক ছিল চাকাগুলো।বর্তমানে আটটি চাকা। বাকি চারটি কলেজ মাঠে  পরিত্যক্ত হয়ে  পড়ে আছে। চাকার পরিধি নয় ফুট সাড়ে ছয়  ইঞ্চি, চাকাগুলো  চওড়া সাড়ে নয় ইঞ্চি। নয় চূড়ার রথটির উচ্চতা ত্রিশ ফুট, ধ্বজা নিয়ে উচ্চতা প্রায় ছত্রিশ  ফুট। দৈর্ঘ্য পনের ফুট ছয় ইঞ্চি প্রস্থও  তাই।  চতুর্থতল বিশিষ্ট রথের সর্বোচ্চ তলে বিরাজ করেন শ্রীরামচন্দ্র সীতা দেবী,  লক্ষ্মণ,  ভরত, শত্রুঘ্ন ও হনুমানের সঙ্গে  শালগ্রাম শিলা  রঘুনাথজীউ। বারাণসী থেকে আনানো প্রতিমা  রামচন্দ্র প্রায় ষাট কেজি , সীতা দেবী পঞ্চাশ কেজি, অন্যান্য মূর্তি চল্লিশ কেজি পেতল দিয়ে নির্মিত । কাঠের তৈরি  এক সারথি দুটো ঘোড়ার রথ চালনা করেন। রথে মোট চোদ্দটি দারু মূর্তি  থাকে। এদের মধ্যে রক্ষক, দ্বারপাল, নর্তকী,নারদ ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য। রথের পূর্বে  সমস্ত মূর্তির  পুজোর ঐতিহ্য  এখনো বজায় আছে। রথের সম্মুখ ভাগে ডান দিকে  রামচন্দ্র ও বাঁ দিকে  বজরঙ বলি হনুমান ও অন্যান্য দিকে সীতা , লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন , ব্রহ্মা -বিষ্ণু -মহেশ্বর    গৌরাঙ্গ- নিত্যানন্দ- অদ্বৈতর মূর্তি   এগুলো  নাড়াজোলের বিখ্যাত পট শিল্পীদের আঁকা। রথের ভেতরে  চার তলা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি আছে।
রথটি দিন পনেরো আগে  থেকেই রাজবাড়ির  সিংহ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে  থাকে।  ঐ সময়ে রথটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, রং দেওয়া এবং  রথে নারকেলে তেল মাখানোর কাজ চলে।রামনবমীর দিন মন্দির থেকে  পালকিতে করে শ্রীরামচন্দ্র প্রমুখের প্রতিমা রাজ পরিবারের সদস্য ও জনসাধারণ দ্বারা বাহিত হয়ে  রথে আসেন। চতুর্থতল বিশিষ্ট রথের সর্বোচ্চ তলে বিরাজ করেন  দেবতা সমূহ।
রাজাদের রাজত্ব নেই ,সেই জাঁকজমকও আর  নেই।কিন্তু কিছু আনুষ্ঠানিকতা এখনো বজায় আছে। রথের আগের দিন ঠাকুরের  ‘দোহরি’ ভোগ হয়।দোহরি ভোগ অর্থে  দুবার ভোগ রান্না করে দুবার  দেখানো হয়। পূর্বে এই ভোগ রাজপরিবারে সমস্ত সদস্য ও রাজকর্মচারীরা খেতেন। অতীতে   গড়খাই থেকে মাছ ধরা হত ও  ঝাঁকরার দিঘি থেকেও মাছ আসতো। রামনবমীর দিন  ঠাকুরকে অন্ন ভোগ দেখানো হয় না। এদিন  চূর্মী(চূর্ণী?) ভোগ হয়।  আটার লুচি ঘিয়ে ভেজে গুঁড়ো করে গুড় দিয়ে  লাড্ডু  বানিয়ে  হনুমানকে নিবেদন করা হয়। অন্যান্যদের ফল মিষ্টি।
রাজাদের স্বর্ণ যুগে রথ টানার বর্ণনা দিতে গিয়ে দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর   ‘নাড়াজোল- এক অনন্য জনপদ ‘ গ্রন্থে জানিয়েছেন, প্রথমেই থাকতো দুটো সুসজ্জিত হাতি, এরপরে পঞ্চাশ জন ঘোড় সওয়ার  , তারপরে থাকতো পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল।  এর পর রথ ।  রথের পেছনে  পালকিতে থাকতেন রাজ পরিবারের লোকজন। লঙ্কা গড়ে  রথ পৌঁছানোর পর  রাজার গলায় বহু মূল্যের  ‘লঙ্কা বিজয় মালা ‘ পরিয়ে দেওয়া হত।  বর্তমানে শোলার মালা আর গাঁদা ফুলের মালার  ব্যবস্থা। লঙ্কা  বিজয় উপলক্ষে তোপ দাগা,   নীলকন্ঠ পাখি উড়ানো ও   প্রচুর আতসবাজি পোড়ানো  হত। বর্তমানে নীলকন্ঠ  পাখি উড়ানো না হলেও বাজি পোড়ানো হয় তবে তা আইন মেনে নম নম করে।
রামনবমীর দিন রথ যাত্রা উপলক্ষে সুদূর অতীত থেকে  নাড়াজোলের  লালবাগানে আদিবাসী মেলা বসে। প্রচুর আদিবাসী সমবেত হন  নবমীর দিন। হাঁড়িতে ভরা হাড়িয়া,  বাখড় দিয়ে কাটানো মদ , মাংস, ঝিনুকের ঝাল সহ  বিভিন্ন চাট বিক্রি হয়।  সন্ধ্যা নামলে একে একে লন্ঠন জ্বলে উঠে লন্ঠন মেলাতে পরিণত হয় লালবাগান।  আলো আঁধারিতে, ক্রেতা বিক্রেতার দরকষাকষিতে , আদিবাসীদের  নাচে গানে মাদলের শব্দে এখনো সরগরম হয়ে উঠে মেলা। কৈশোর অতিক্রান্ত আদিবাসী  ছেলেমেয়েদের  পারস্পরিক চেনা জানা  হয় এই মেলাতে।
মুখে মুখে এক সময়ে ফিরতো , ‘রথ দেখবি তো  নাড়াজোলে/ জাত দেখবি তো  কানাশোলে’।  নাড়াজোলের জাত প্রায়  এক মাস ধরে বসতো। এখনো পনেরো দিন বসে। গৃহস্থালির  জিনিসপত্র,  কৃষি কাজের  জিনিস কেনার জন্য আর বিনোদন উপভোগ করতে বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এখানে  আসতো।  সন্ধ্যায় হ্যারিকেন লাইট,  ডে লাইট, গ্যাস লাইটের আলোতে  লঙ্কাগড় আলোকিত হয়ে যেত।জাতে  মাদুর , শীতল পাটি, সঁপ , ঝ্যাঁতলা, রঙিন চ্যাটা , বেনা কাঠির ঝাঁটা, তালপাতার পাখা, স্টেশনারি দোকানের জিনিস , কাটারি কুড়োল কোদাল কাস্তে লাঙল জোয়াল, ছালা  গুণপাটি,   শিমুল তুলো ইত্যাদি পাওয়া যেত। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল মুগের জিলিপি। বিনোদনের জন্য ছিল পুতুল নাচ (বেণী পুতুল নয়), যাত্রা, রাম যাত্রা, কেষ্টযাত্রা,কবিগান,সার্কাস ,চিড়িয়াখানা এই সব। বর্তমানের জাতে গৃহস্থালির জিনিসপত্র বদলেছে,পাল্টে গিয়েছে খাওয়ার রুচি,পরিবর্তন এসেছে বিনোদন ব্যবস্থায়  আর  আলোকসজ্জায়।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ  হওয়ার  পূর্বে  রথের  সমস্ত খরচ রাজ পরিবার  বহন করতেন। তাঁরাই  সব কিছু   পরিচালনা করতেন। জমিদারি আয় কমে গেলে রথ পরিচালনার  ভার  পরিচালন কমিটির উপর ন্যস্ত হয়। রাজবাড়ি থেকে এখনো আর্থিক  সাহায্য আসে,  তবে  তাতে সমস্ত  ব্যয় সংকুলান হয় না। স্থানীয় ব্যবসায়ী আর মানুষের  সার্বিক সহযোগিতায় রথের চাকা এখনো গড়াচ্ছে।
ঘাটাল মহকুমার দুশো বছরেরও বেশি পুরানো রথটি  রক্ষণাবেক্ষণে, সংরক্ষণে আমাদের  সকলের  দায়িত্ব  আছে। এই রথ যাত্রা কেবল আর  ধর্মীয়  বিষয় নয়  এ আমাদের  ইতিহাস,  আমাদের গর্ব।
•সাহায্য  নিয়েছি যে গ্রন্থ  থেকে:  নাড়াজোল- এক অনন্য জনপদ।  দেবাশিস ভট্টাচার্য।
ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছেন: দেবাশিস ভট্টাচার্য, প্রভুদয়াল খাঁন, বিদ্যুৎ খাঁন, সন্দীপ খাঁন  প্রমুখ।
•ছবিগুলো শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেবাশিস ভট্টাচার্যের  সৌজন্যে প্রাপ্ত।

তৃপ্তি পাল কর্মকার

আমার প্রতিবেদনের সব কিছু আগ্রহ, উৎসাহ ঘাটাল মহকুমাকে ঘিরে... •ইমেল: [email protected] •মো: 9933066200 •ফেসবুক: https://www.facebook.com/triptighatal •মোবাইল অ্যাপ: https://play.google.com/store/apps/details?id=com.myghatal.eportal&hl=en ইউটিউব: https://www.youtube.com/c/SthaniyaSambad

Join WhatsApp

Join Now

Join Telegram

Join Now