তৃপ্তি পাল কর্মকার, ‘স্থানীয় সংবাদ’: মাতৃত্বের চিরায়ত পরম্পরায় এমন কাহিনী খুব কম শোনা যায়। মা তার সন্তানকে ভালোবাসে, পরম মমতায় আগলে রাখে বুকে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে পরম মমতায় বুকে আগলে দায়িত্ব পালন করতে আজকের দিনে কে এগিয়ে আসে?
চলুন এবার শোনাই এই নজিরবিহীন কাহিনী। চলুন জেনে নিই কে সেই ব্যতিক্রমী মা, যার হয়তো অভাব অনটনে কায়ক্লেশে সংসার চলে কিন্তু রয়েছে সোনার মতো দামী মন- মানসিকতা। যা আজকের দিনে কল্পনার অতীত।
১৬ অক্টোবর পাঁশকুড়া থেকে ঘাটালগামী বাসে বছর দেড়েকের বাচ্চা মেয়েকে সিটে বসা এক মাছ বিক্রেতা মহিলার কোলে ধরতে দিয়ে বাস থেকে নেমে যান এক যুবক। খানিক পরে বাসে খোঁজ করেও যখন খোঁজ মেলেনি যুবকের, তখন ওই মাছ বিক্রেতা মহিলা মধ্য চল্লিশের রেবতী ভুঁইয়া বাচ্চাটিকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসেন দাসপুর থানার জগন্নাথপুরে। দুপুরে নিজে খেয়ে বাচ্চাটিকে খাইয়ে আবার বাচ্চাটিকে কোলে করে পাঁশকুড়াগামী বাসে উঠে পড়েন যুবকটির খোঁজে। জগন্নাথপুর থেকে প্রতি স্টপেজে নেমে বাচ্চাটিকে দেখিয়ে যুবকটির খোঁজ করতে থাকেন। কেউ খোঁজ দিতে পারেনি ওই যুবকের। এরপর পাঁশকুড়া থানায় যান বাচ্চাটি নিয়ে। পাঁশকুড়া থানা দাসপুর থানায় যোগাযোগ করতে বলে। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে রাতে দাসপুর থানায় আসেন রেবতীদেবী। দাসপুর থানা থেকে বাচ্চাটিকে দাসপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুর থেকে কার না কার বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে কেমন যেন মায়ার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছেন রেবতীদেবী। হাসপাতালে তাই দস্যি বাচ্চাটিকে একা ছেড়ে পালাতে পারেননি। পরের দিন ১৭ অক্টোবর বাচ্চাটিকে ঘাটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রেবতী দেবীর মাতৃক্রোড়ের মধ্যেই ঘাটাল হাসপাতালে চলে একরত্তি শিশুর দুরন্তপনা। আধো আধো বুলিতে কোলের মধ্যে দাপাদাপি করতে করতে কত শত দুর্বোধ্য ভাষার ফুলঝুরিতে ভরিয়ে দেয় এই নতুন মাকে। পরম মমতায় আপন সন্তান স্নেহে সেসব সামলাতে সামলাতে মন কেঁপেছে রেবতীদেবীর, অভাব অনটনের সংসারে তাঁর নিজের স্বামী সন্তান কী খাচ্ছে, অনভ্যস্থ হাতে তাঁরা কেমন চালাচ্ছে ঘরকন্না!
এরমধ্যে পুলিশ চাইল্ডলাইনে যোগাযোগ করে আর ‘স্থানীয় সংবাদ’-এর ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে শিশুটির প্রত্যেক সময়ের আপডেট আমরাই প্রথম দিতে শুরু করি। খোঁজ মেলে শিশুর পরিচয়। শনিবার ১৬ অক্টোবর থেকে সোমবার ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিন পরম মমতায় বুকের উষ্ণতা দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে আগলে রেখেছিলেন রেবতীদেবী। আইনের মারপ্যাঁচ কাটিয়ে সোমবার ১৮ অক্টোবর বিকেলে গর্ভধারিণীর কাছে ফিরে যায় একরত্তি শিশুটি। রেবতীদেবীর চোখে তখন আনন্দ ও বেদনার মিলিত প্রবাহের বন্যা। হোক না তিন দিনের মা! তবুও তো মা! পরম যত্নে পরম মমতায় বুকে সন্তান আগলে রাখা মা।
গর্ভধারিণী মা দাসপুর থানার নবীন মানুয়ার বছর বাইশের সীমা রাউত তাঁর মেয়ের রেবতী মা’কে বলে গেছে দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠবে আত্মীয়তার বন্ধন। রেবতী মা যখন খুশি মেয়েকে দেখতে আসবে, আর মেয়েও যাবে তার রেবতী মায়ের বাড়ি।
আজকের যুগ বড়ই আত্মকেন্দ্রিকতার যুগ, মানুষ নিজের আখের গুছিয়ে আর কারোটি চেনে না। স্বার্থপরতার গণ্ডি ভেঙে পরের ঘরের সন্তান বুকে আগলে হাসপাতালে পড়ে থাকার জন্য অভাবী রেবতীদেবীর মতো বড়ো মন লাখেও মেলে না একটা। স্যালুট এবং কুর্নিশ রেবতীদেবীর এই অচেনা মাতৃত্বকে।