দেবাশিস কুইল্যা•শ্যামগঞ্জ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় দুর্বাচটি খালের পশ্চিম পাড়ে ছোটগ্ৰাম। ছবির মত বট-পাকুড়ের ছায়াঘেরা ঘাটে কত মানুষের নিত্যদিনের পরিচিত পারাপার। একে অপরের সম্পর্ক বিনি সুতায় গাঁথা। খেয়াঘাট পার হয়ে কুমোরপাড়া ছাড়িয়ে যেপথ গ্ৰামান্তরে চলে গিয়েছে, সেই পথে কত ঘটনার ইতিকথা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু তারই চিহ্ন রয়ে গিয়েছে কালের কাছে। যা উত্তর প্রজন্মের কাছে রেখে যায় তার গর্বিত ইতিহাস।
দেশের আধুনিক ইতিহাস শুরু হওয়ার কিছু পর ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্ন সভাসমিতি গঠনের মাধ্যমে যে উদারপন্থী রাজনীতির ধারা প্রচলিত ছিল তার প্রভাব দেখা যায় সমগ্ৰ মেদিনীপুর জেলা জুড়ে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষের সঙ্গে সাজুয্য রেখে স্বদেশীকতার পিতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসু সমগ্ৰ মেদিনীপুর জেলা জুড়ে বিভিন্ন সংস্কারমূখী আন্দোলনের সূচনা করেন। রাজনারায়ণের প্রভাবে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্যারিলাল ঘোষ, হেমচন্দ্র কানুনগো বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিংশ শতকের শুরুতে তথা ১৯০২ সালে মেদিনীপুর শহরে গঠন করেন গুপ্তসমাতি। যার শাখা জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন জায়গার সাথে এই মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় সভা আয়োজন এবং স্বদেশী আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করেছেন নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান, তার পুত্র দেবেন্দ্রলাল খান, চন্দ্রকোণা কেঁচকাপুরের জমিদার বিহারীলাল সিংহ, নাগেশ্বর সিংহ, আশুতোষ সিংহ, জাড়ার জমিদার যোগেশচন্দ্র রায়, তাঁর দুই পুত্র কিশোরীপতি রায় এবং সাতকড়িপতি রায়। এঁদের অনুরোধে ১৯০৬ সালের ২১ জুলাই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালের কুশপাতায় ১৩ হাজার শ্রোতার সামনে স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ওই বছরই দাসপুর গঞ্জে সতীশচন্দ্র রায় স্বদেশী দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র খোলেন।
স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাপ বারে বারে সমৃদ্ধ করেছে ঘাটাল মহকুমার জনপদ। বিশেষ করে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের পর মহকুমার বিপ্লবীরা বিভিন্ন গুপ্তসমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তোলেন যথাক্রমে কেঁচকাপুর, জাড়া, ক্ষীরপাই, খড়ার, নন্দনপুর, সোনাখালি, চেঁচুয়া, রাধাকান্তপুর, শ্যামগঞ্জ, রামজীবনপুরের পুরনো হাটতলা ও ঘাটালের কুশপাতায়। বিভিন্ন আন্দোলন ও সভার মাধ্যমে বিভিন্ন গুপ্তসমিতিগুলির মধ্যে যোগাযোগ নিবিড় হওয়ার ফলে প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবী ও দলের কাছে অনায়াসে পৌঁছে যেত যুগান্তর, সন্ধ্যা, নবশক্তির মতো ইংরেজ সরকারের বিভিন্ন নিষিদ্ধ পত্রপত্রিকা।
১৯৩০ সালে গান্ধীজীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলে সমগ্ৰ মেদিনীপুর জেলার সাথে ওই মহকুমার গুপ্তসমিতিগুলিতে। এই আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল দাসপুরের শ্যামগঞ্জ ও ঘাটালের হরিশপুরে। এই দুই কেন্দ্রে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন মহকুমার কংগ্ৰেসের সম্পাদক যতীশচন্দ্র ঘোষ, সভাপতি মোহিনীমোহন দাস, তাঁর পুত্র স্বদেশরঞ্জন দাস, রামমোহন সিংহ, মন্মথকুমার মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী সহ স্থানীয় লোকজন। এঁদের নেতৃত্বে ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় লবণ আইন অমান্য আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন সংগঠিত হয়। ঘাটাল মহকুমায় লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।
শ্যামগঞ্জ ও হরিশ্চন্দ্রপুর। সত্যাগ্ৰহী ও নেতৃত্বদের ওই দুই জায়গা লবণ তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল– রূপনারায়ণের জোয়ার বাহিত নোনাজল হতে লবণ তৈরির উপযুক্ত ভৌগলিক অবস্থান এবং উৎপাদিত লবণ বিক্রয়কেন্দ্র হিসাবে ঘাটাল বাজার ও চেঁচুয়ার হাট। ১৯৩০ সালের ৭ এপ্রিল শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরি শুরু হল। তার কিছুদিন পর শুরু হয় হরিশপুরে। স্থানীয় জনসাধারণের অসহযোগিতা, নেতৃত্বের অভাব ও পুলিশের নিগ্রহের ফলে হরিশপুরে লবণ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে শ্যামগঞ্জে উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে লবণ তৈরির কাজ চলতে থাকে। এখানে নেতৃত্ব দেন সুরেন্দ্রনাথ অধিকারী, মৃগেন ভট্টাচার্য, যোগেন হাজরা, বিনোদবিহারী বেরা, অরবিন্দ মাইতি, মন্মথ চক্রবর্তী, কাননবিহারী গোস্বামী প্রমুখ স্থানীয় বিপ্লবীরা। এই আন্দোলনে শ্যামগঞ্জ ও তার আশেপাশের মানুষ পিছিয়ে ছিল না। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বরা ছিলেন ভোলানাথ ঘোড়ই, অনন্ত খাটুয়া, হরিপদ মণ্ডল, সুরেন পাল সহ অন্যান্যরা।
এখানে লবণ তৈরিকে কেন্দ্র করে পুলিশের অত্যাচার ও নির্যাতন দিনের পর দিন বাড়লেও সত্যগ্ৰহীরা পিছিয়ে আসেনি। বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে কেউ না কেউ লবণ তৈরি করে গিয়েছেন। আর এই সব স্বদেশীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যাবস্থা করেন সুরেন পালের মা গৌরী পাল। স্বদেশীদের কাছে যিনি বুড়িমা নামে পরিচিত ছিলেন। স্বদেশীদের লবণ তৈরির কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করাই নয়, ষাটোর্ধ্বের এই মহিলা পুলিশের অত্যাচার ও নিপীড়ণের হাত থেকে রক্ষা করা ও পুলিশের অভিযান বানচাল করার জন্য প্রতিবেশী ও গ্ৰামের মহিলাদের নিয়ে গঠন করেন প্রমিলা বাহিনী। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন পালেদের নাট মন্দিরের পেছনের ঝোপে এবং পাশাপাশি বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করতেন স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। দাসপুর থানার দারোগা ভোলানাথ ঘোষের নেতৃত্বে পুলিশী অভিযান শুরু হলে বুড়িমার নির্দেশে প্রমিলা বাহিনীর সদস্যরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। অনেকবার এই আক্রমণের কাছে ভয় পেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ বাহিনী। দিনদিন যত পুলিশী অত্যাচার বেড়েছে প্রমিলা বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার কৌশলও বদল হয়েছে।
প্রমিলা বাহিনী ও স্বদেশীদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের কথা থানায় জানিয়ে দেওয়া হত। এর মূলচক্রীরা ছিল স্থানীয় ভুষিমাল ও কাপড় ব্যবসায়ী ধরণী দাস ও অতুলচন্দ্র দাস। এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বুড়িমা ও তার কয়েকজন সহযোগী দুই দোকানে আগুন লাগিয়ে দুজনকে প্রকাশ্যে রাস্তায় কানেধরে উঠবোস করান। তার কিছুদিন পর্যন্ত নিশ্চিন্তে স্বদেশীরা লবণ তৈরি করে গিয়েছেন।
১৯৩০ সালের ৩ ও ৬ জুন চেঁচুয়া হাটের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম সারির নেতৃত্বরা গ্ৰেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার ও দমন পীড়ন তীব্র হলে শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরির কাজ ব্যাহত হয় এবং পরে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
লবণ আইন অমান্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শ্যামগঞ্জের ঘটনা এবং গৌরী পালের নেতৃত্বে প্রমিলা বাহিনীর উদ্দ্যেশে জহরলাল নেহেরু বলেন, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেয়েরা উপস্থিত করেছেন আমরা তা ভুলতে পারিনা। মেদিনীপুরে যা ঘটে গিয়েছে তাও স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়।
দাসপুর থানার শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরি ও চেঁচুয়া হাটের ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অন্যতম নজির। অতীতের ছোট ছোট ঘটনার সংযুক্তিকরণে বৃহৎ ইতিহাস তৈরি হয়। শ্যামগঞ্জ আজ বৃহৎ ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে গিয়েছে। নদী মোহনায় মিশে যাবার পর তার অস্তিত্ব যেমন হারিয়ে ফেলে ঠিক সেইভাবে স্থানীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। শ্যামগঞ্জের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শ্যামগঞ্জে লবণ তৈরির ঘটনা ও তার সঙ্গে সংস্পৃক্ত আন্দোলনকারী বীর সেনানীগণ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসে শ্যামগঞ্জ যেন এক দুয়োরানি। এই ভুলে যাওয়া মানসিক দৈন্যতা ছাড়া কিছু নয়!
তথ্যসূত্র:১) মেদিনীপুর -তরুণ ভট্টাচার্য। ২) অশোক পাল(অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক)। ৩)নাড়াজোল:এক অনন্য জনপদ -দেবাশিস ভট্টাচার্য। ৪) সাক্ষাৎকার; নিরঞ্জন মাইতি। শ্যামগঞ্জ, দাসপুর পশ্চিম মেদিনীপুর।