অর্জুন পাল[WBCS, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ঘাটাল মহকুমা]: সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ঘাটাল মহকুমার ইতিহাস প্রখর মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো ভাস্বর। এই মহকুমা মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর স্মৃতিবিজড়িত। কথিত আছে, কবি বর্ধমানের অধিবাসী হলেও, অভাবের [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]তাড়নায় নিজ গ্রাম ছেড়ে পরিবার সহ ‘গোচড্ডা’ গ্রামে এসে পৌঁছন। এই গ্রাম বর্তমানে খুব সম্ভবত চন্দ্রকোণা থানার ৭নম্বর মৌজায়। এই গ্রামেরই একটি পুকুর পাড়ে যখন কবি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন দেবী চণ্ডী স্বপ্নে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনার আদেশ দেন। কিন্তু কবির তখন নিদারুণ অভাব। দুবেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থান করাও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি কি করে নতুন করে কাব্য রচনা করবেন? কবির অভাব দূর করার জন্য তাঁকে ব্রাহ্মণগ্রাম পরগণার (বর্তমান কেশপুর) রাজা রঘুনাথ রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শও নাকি দিয়েছিলেন দেবী। সেই মতো কবি রাজা রঘুনাথ রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৫৯৫ সাল নাগাদ চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। রঘুনাথ রায়ের প্রচেষ্টায় চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ব্যাপক প্রচার হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কবিকঙ্কন এই মহকুমার কবি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু সাহিত্যের সৃষ্টি ভৌগোলিক সীমারেখায় বাঁধা যায় না। আর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনার অনুপ্রেরণা তো কবি এই মহকুমায় অবস্থানকালেই পেয়েছিলেন। চণ্ডীমঙ্গলের দিগবন্দনায় চন্দ্রকোণা এবং এই মহকুমার আরও কয়েকটি স্থানের উল্লেখ আছে।
কবিকঙ্কনের পরে মধ্যযুগের অপর এক উল্লেখযোগ্য কবি শিবমঙ্গল এবং সত্যপীরের পাঁচালি কাব্যের রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তীর জন্মস্থান ছিল খড়ারের পূর্বদিকে ঘাটালের যদুপুর গ্রামে। শিবের গাজন এবং দুর্গাপুজোর সময় এখনও মহকুমার পুরোনো পুজোগুলিতে শিবমঙ্গল পাঠ করা হয়ে থাকে। যদিও পরবর্তীকালে শোভা সিংহের অত্যাচারে কবি যদুপুর ত্যাগ করে কর্ণগড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কর্ণগড় দুর্গের দক্ষিণপশ্চিমে একটি বেদির ভগ্নাবশেষ আছে যেখানে বসে কবি কাব্যরচনা করতেন। রামেশ্বরের কিছু পরে বরদা পরগণার অপর এক কবি ছিলেন অকিঞ্চন চক্রবর্তী। তাঁর জন্মস্থান ছিল ক্ষীরপাইয়ের দক্ষিণে আটঘরা গ্রামে। মুকুন্দরামকে অনুসরণ করে তিনিও চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেছিলেন। যদিও কবিকঙ্কনের অসাধারণ জনপ্রিয়তা হেতু ইতিহাসে তিনি অনেকটাই নিষ্প্রভ। অকিঞ্চন শীতলামঙ্গলও রচনা করেছিলেন। ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন স্থানে আজও শীতলাপুজো উপলক্ষে তাঁর গান গাওয়া হয়ে থাকে।
শোভা সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় বরদা পরগণার হরিরাম নামে এক কবি অদৃজামঙ্গল নামক এক কাব্য রচনা করেছিলেন। শোভা সিংহের বিদ্রোহের আগেই এই কাব্যরচনা শেষ হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই কাব্যে শোভা সিংহকে বঙ্গ অধীশ্বর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই অঞ্চলেরই দ্বিজ গঙ্গাদাস নামক এক কবি রচনা করেছিলেন অভয়ামঙ্গল নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। এখানে সেই সময়ের জমিদার দলপতি রাজার নাম উল্লেখ আছে। বর্ধমানের অম্বিকা কালনার কবি প্রাণবল্লভ ঘোষ একসময় বরদা পরগণার চেতুয়া কাছারির বড়বাবু ছিলেন। তাঁর রচিত জাহ্নবীমঙ্গল কাব্যের রচনাকাল আনুমানিক ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ। এটিতে বাসুদেবপুর গ্রাম থেকে আবিষ্কার হয়েছে। এই পুঁথিটির মধ্যেকার কতগুলি কড়চা থেকে সে সময়ে মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া চেতুয়া পরগণায় শংকর ও কৃষ্ণকিঙ্কর নামে আরও দুই সমসাময়িক কবির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এনারা মূলত পালাগান রচনা করতেন। অতি সম্প্রতি এই দুজন কবির পালা গানের কিছু পুঁথি পাওয়া গেছে যেখান থেকে দাসপুর ও চেতুয়া অঞ্চলের তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। প্রাচীন চন্দ্রেশ্বর খাল খননের কথা কৃষ্ণকিঙ্করের পঞ্চাননমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ আছে। কৃষ্ণকিঙ্কর খেপুতের অধিবাসী ছিলেন। শংকর ঘাটালের রানীর বাজারের অধিবাসী ছিলেন এবং ষষ্টিমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ছিলেন। দাসপুরের কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তীর রচিত শীতলামঙ্গল কাব্যটি আজও শীতলাপুজো উপলক্ষে ঘাটালের বিভিন্ন স্থানে গাওয়া হয়ে থাকে। ধর্মমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা মানিক গঙ্গোপাধ্যায় ঘাটালের উত্তরদিকে বেলডিহা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ঘাটালের বরদা, রাধানগর প্রভৃতি স্থানে ধর্মঠাকুরের মন্দির পরিলক্ষিত হয়। এই ধর্মঠাকুরের কাহিনী নিয়েই ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছিল।
এই মহকুমার মধ্যযুগের কবিরা মূলত মঙ্গলকাব্যের গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করে পালাগান রচনা করেছেন। তাই তাঁদের রচনায় খুব একটা মৌলিকত্বের পরিচয় পাওয়া যায় না। কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন কবি ভারতচন্দ্রের রচনার প্রভাবও পাওয়া যায়। এই কাব্যগুলির মধ্যে রচয়িতার নাম মাঝে মাঝে নিহিত থাকে- ফলে এটি কার লেখা তা অনুমান করা যায়। এছাড়া এই সময়ে কিছু শ্যামা সংগীত বা দুর্গাপুজোর পালাগান রচনা হলেও সেই সব রচনার উৎস বর্তমানে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।