ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চর্চা সেই আশির দশক থেকে। কিন্তু তার আগে ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ঘাটালের মানুষের মগজে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ঘাটালের সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। তারপর এই শিলাবতী নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য দড়ি টানাটানি হয়েছে, তার চেয়েও বেশি হয়েছে বিস্তর রাজনীতি। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাসের পর থেকে প্রায় ৪০ বছর অতিক্রান্ত। এখনও অধরা। বন্যা ও ভোটের সময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ভূত। আর রাজনীতির ঘুর্ণাবর্তে খাবি খাচ্ছে ঘাটালের মানুষ। এখন প্রশ্ন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ কী আদৌ সম্ভব? প্রশ্ন তুললেন শ্রীকান্ত পাত্র
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্মের ইতিহাসে যাচ্ছি না। এক কথায় ১৯৫৯ সালে মান সিং কমিশন গঠনের পর রাজ্য সরকার ১৯৮২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঘাটালের শিলাবতী নদীর বাঁধে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পাথর পুঁতে দিয়েছিলেন সেচ মন্ত্রী প্রভাস রায়। তারপরও কেটে গিয়েছে প্রায় তিন দশক। কোনও এক অজানা কারণে এক চুলও এগোয়নি বামফ্রন্ট সরকার। ২০০৭ সালে একটা বড়সড় বন্যা ঘটে যাওয়ার পর ফের চাগাড় দেয় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। ২০০৮ সালে রাজ্য সরকার পূর্বতন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের অংশ বিশেষ ঝাড়পোঁছ করে একটি সার্বিক পরিকল্পনায় হাত দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারি পরামর্শদাতা সংস্থা ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড তথা ওয়াপকস’কে(WAPCOS) একটি প্রকল্প তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সংস্থা ও রাজ্যের সেচ ও জলপথ বিভাগ যৌথভাবে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট একটি রিপোর্ট জমা দেয়। প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১৪৯২ কোটি টাকা। কিন্তু তারও কিছু ভুল ত্রুটির কারণে খড়্গপুর আই আই টি দ্বারা সংশোধিত হয়ে ২০১১ সালের জুলাই মাসে তা চূড়ান্ত হয়। এই রিপোর্টই গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন (জি এফ সি সি) দ্বারা অনুমোদিত হয়ে কেন্দ্র সরকারের ঘরে আজও পড়ে রয়েছে অর্থ দফতরের অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক অনুমোদন মিলেছে অবশ্যই। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৪০ কোটি টাকা। বলে রাখি, জি এফ সি সি র ছাড়পত্র পেয়েছে ২০১৫ সালের মে মাসে। আরও বলে রাখি, মোট প্রকল্প ব্যয়ের অংশ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরোধ বাধে। শেষমেষ ৫০:৫০শেয়ারে কেন্দ্র সরকার রাজি হলেও রাজ্য সরকার আজও সম্মত হয়নি। রাজ্যের দাবি, জনস্বার্থে কেন্দ্রকে প্রকল্প ব্যয়ের ৭৫ ভাগ দিতেই হবে। যা কেন্দ্র সরকার মানতে নারাজ। এই নিয়ে দড়ি টানাটানি আজও চলছে। কোনও ফয়সালা হয়নি। যা হচ্ছে শুধুই রাজনীতি আর রাজনীতি। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ না হওয়ার এটি একটি বড় কারণ। এর মধ্যে প্রকল্প ব্যয় কিন্তু থেমে নেই। রাজ্য সেচ দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এই প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় দু’ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা(কেন্দ্রীয় জল সম্পদ দপ্তরের উপদেষ্টা কমিটি ২০১৮ সালে ৮ জুন এই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন)। যত দেরি হবে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়তে থাকবে।
স্থায়ীভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৩৮৩৯ হেক্টর ও অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে হবে ৯০৮৩ হেক্টর জমি। মোট ১২ হাজার ৯২২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে রাজ্য সরকারকে। কত বিঘা জমি ভেবে দেখুন। এই পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হলে ঘাটাল ব্লক ও ঘাটাল শহরের অস্তিত্বই তো বিপন্ন হয়ে পড়বে। ওই জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা এই সরকার এই বিপুল পরিমাণ জমি কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আওতায় রয়েছে দুই মেদিনীপুর জেলার ১৩টি ব্লক ও পাঁচটি পুরসভা এলাকা । ওয়াপকসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘাটালে বন্যার জন্য দায়ী মূলত কংসাবতী ও শিলাবতী নদী। প্ল্যান রূপায়ণের জন্য কংসাবতী অববাহিকা অঞ্চলে ১২টি ও শিলাবতী অববাহিকা অঞ্চলে ৯টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঘাটালের বন্যা রুখতে যেগুলি রূপায়ণ জরুরি। যেমন, দুই নদী সংস্কার, দুই পারে বাঁধ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, আলাদা করে রাস্তা নির্মাণ প্রভৃতি রয়েছে। এর সঙ্গে চেতুয়া, মোহনখালি, দুঃশ্বাসপুর ও শোলাটোপা সার্কিট থেকে জবর দখল করে থাকা কয়েক হাজার ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হবে। ওয়াপকসই বলেছে, এই সার্কিট বাঁধগুলির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। রক্ষণা-বেক্ষণ ও মজবুতিকরণের কাজ প্রায় দুঃসাধ্য। মূলত ঘাটাল শহরের অনেকটাই কিন্তু শিলাবতী নদীর বাঁধেই অবস্থিত। প্রস্তাবে বলা আছে, এই জবরদখল কারীদের সরে যেতেই হবে। শিলাবতী, কংসাবতী, দুই কাঁসাই, দুর্বাচটি, প্রভৃতি নদীগুলিকে একশো থেকে দেড়শো মিটার পর্যন্ত চওড়া করতে হবে। ছোটো একটা উদাহরণ দিই, শিলাবতী নদী দেড়শো মিটার চওড়া করলে ঘাটাল শহরের মহকুমা শাসকের কার্যালয়টি থাকবে তো? এবার দুই পাড়ের দৃশ্য ভাবুন! নদীগুলির সংস্কার হলে বিপুল পরিমাণ মাটি কোথায় থাকবে? প্রস্তাবে বলা আছে উচ্ছেদ হওয়া কয়েক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন দিতেই হবে। প্ল্যান রূপায়ণ করতে জমি অধিগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, স্থায়ীভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৩৮৩৯ হেক্টর ও অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে হবে ৯০৮৩ হেক্টর জমি। মোট ১২ হাজার ৯২২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে রাজ্য সরকারকে। কত বিঘা জমি ভেবে দেখুন। এই পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হলে ঘাটাল ব্লক ও ঘাটাল শহরের অস্তিত্বই তো বিপন্ন হয়ে পড়বে। ওই জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা এই সরকার এই বিপুল পরিমাণ জমি কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে? ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দীর্ঘায়িত করার এটিও একটি বড় কারণ। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আটকে যেতে পারে। প্রস্তাবে আরও অনেক শর্ত রয়েছে যা এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তাই রাজ্য সেচ দফতরের এক আধিকারিক বলেছেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ ও সোনার পাথরবাটি একই। তাহলে কী ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কোনোদিন রূপায়ণ হবে না? ঘাটাল কী চিরকাল ডুববে? আপনাদের অবগত করাই, এই সমস্যা উপলদ্ধি করেই হয়তো দাসপুর পঞ্চায়েত সমিতি, ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতি, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি এমনকি বামেদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলি জমা পড়েছে তার সারাংশ হল দাসপুরে শিলাবতী নদীর সুরতপুর থেকে বা কাঁসাইয়ের গোকুলনগর থেকে বৈকুণ্ঠপুরে চন্দ্রেশ্বর খালের সঙ্গে একটি নতুন করে খাল কেটে যুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জল প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদে গিয়ে পড়বে। তাহলে ঘাটালের বন্যা প্রবণতা কমবে বলে দাবি করা হয়েছে। এই প্রায় চার কিলোমিটার খাল কাটতেও সেই বাধা জমি অধিগ্রহণ। তার উপর চন্দ্রেশ্বর খাল কাটাই নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে একটি মামলা জিইয়ে রয়েছে এখনও। তার সমাধান কিন্তু জরুরি। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় বলে রাখি, চন্দ্রেশ্বর খাল কাটাই শুরু হলেই পাঁচশোর বেশি কৃষক পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবিতে সরব হবেন। তাঁরা আজও ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাঁরা ছেড়ে কথা বলবেন? এই সমস্যাগুলো কোনও রাজনৈতিক দলই খুলে বলছে না। কিছুদিন আগে সেচ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ঘাটালকে যেভাবেই হোক বন্যার হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আমাদের প্রায়োরিটি। দরকার হলে বিকল্প ভাবতে হবে। বিকল্পটা কী তা তিনি খোলসা করেননি। এবার ভাবুন, কবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হবে? বা আদৌ রূপায়ণ হবে কী না।