‘দাসপুরের গেঁড়িবুড়ির মেলার ইতিহাস’ —উমাশঙ্কর নিয়োগী

গেঁড়িবুড়ির জাত 

উমাশঙ্কর নিয়োগী: দাসপুর থানার পুরুষোত্তম পুরে তিন শতাধিক বৎসরের পূর্ব থেকে ধর্ম সংক্রান্তি তথা ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন গেঁড়ি বুড়ির জাত বসে আসছে। সম্ভবত এই জাত দাসপুর থানার প্রাচীনতম জাত।
গেঁড়িবুড়ির মন্দিরটি একরত্ন মন্দির। মন্দির গাত্রে সম্মুখভাগে দুটি হাতি ও রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে। এই মূর্তিটি পরে লাগানো হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। পূর্ব দিকে দুটি পদ্ম ছাড়া কোন দেবদেবী মূর্তি নেই। হাতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক। এতে উৎকীর্ণ কাল জ্ঞাপক সন ১১৬৪। [মেলার লোকেশন👆] মন্দিরটি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার বা নির্মিত হয়েছে কিনা সেই সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। ১৭৫৭খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হলে মন্দিরটির বয়স এখন ২৬৩বছর। একটি মজে যাওয়া বৃহত দিঘির পাড়ে অগ্নি কোণে মন্দিরটি অবস্থিত। দিঘি খননের পূর্ব থেকে ধর্ম ঠাকুরের পুজোর চল হলে ধর্ম ঠাকুরের অবস্থান হাজার বছরের বেশি। সুপ্রাচীন জাতটি চলে আসছে স্মরণাতীতকাল থেকে বলে অনুমান করা যেতে পারে।

এটি ছিল ডোম পণ্ডিতদের তীর্থ কেন্দ্র ।
কিছু দিন আগেও মেলা শব্দের এত ব্যবহার হত না। ঠাকুর বাড়ির ‘হিন্দুমেলা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পৌষ মেলা’ ইত্যাদি থেকে জাত অর্থে মেলা শব্দের প্রয়োগ ব্যাপকভাবে হচ্ছে। অভিধান ‘জাত’ শব্দের বুৎপত্তি নির্ণয় করেছে জন্ + ক্ত ভাব। অর্থ জনতার সমাবেশ। জাঠা শব্দের মূল অর্থ তীর্থযাত্রীদের সমাবেশ। এই শব্দটি হিন্দি হলেও বাংলা শব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। জাঠা শব্দ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাত হয়েছে কিনা ভাষাতাত্ত্বিকগণ ভেবে দেখতে পারেন। জনতার সমাবেশ হত ধর্মকে কেন্দ্র করে। এখন থেকে ৬০-৭০ বছর আগে আমাদের ছেলে বেলায় জাত বসত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভিত্তিক। শ্রীরাম নবমীতে নাড়াজোলে জাত বসতো খাতায় কলমে আট দিনের কিন্তু তা উঠতে উঠতে এক পক্ষ পেরিয়ে যেত, মকর স্নান উপলক্ষে মকর সংক্রান্তিতে ঘাটালের ভাসাপুল ধারে, চৈত্র মাসে শিবের মাথায় জল ঢালা উপলক্ষে লাওদাতে, ভুবনেশ্বর,

চাঁচরে তাতারপুরে, আষাঢ় মাসে রথের সময় তিওয়বেড়িয়াতে, মাঘ মাসের পূর্ণিমায় চেঁচুয়া গোবিন্দনগরে, ধর্ম সংক্রান্তির দিন রামপুর মানুয়াতে, কালী পুজোয় আজুড়িয়াতে। আরো ছোট খাটো জাত বসত গঙ্গা পুজোতে গঙ্গা মাড়োতলা গৌরাতে, কোলমিজোড়ে। বেশ কিছু জাত এখন উঠে গিয়েছে। আমদের ছেলে বেলায় সব থেকে বড় জাত ছিল বগড়ির কিষ্ট রায়ের জাত।
গেঁড়িবুড়ির মন্দিরে ধর্মরাজের একটি কূর্মমৃর্তি আছে। আর আছে আঠারোটি ধর্ম শিলা। কোন নারায়ণ শিলা নেই। ধর্ম শিলাগুলির বিভিন্ন নাম যথা-বাঁকুড়া রায়,যাত্রাসিদ্ধি রায়, স্বরূপ নারায়ণ, নারায়ণ রায়,ক্ষুদি রায় ইত্যাদি। দেবদেবী মূর্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় মূর্তিটি গেঁড়িবুড়ির। এঁর ডান দিকে যথাক্রমে ধর্মরাজ, কালী কল্যাণী, বিশালাক্ষী আর বাম দিকে শীতলা,মনসা,পঞ্চানন, জ্বরাসুর আর মঙ্গলচণ্ডী। গেঁড়ি বুড়ির সেবায়েত জয়দেব পণ্ডিত জানালেন সমস্ত মূর্তিগুলি তাঁদের পূর্বপুরুষ নিকটস্থ সিমলা দিঘি সংস্কারের কালে পেয়েছিলেন। গর্ভ গৃহে গেঁড়িবুড়ির ঠিক মাথার উপরে একটি চতুর্ভুজ মূর্তির টেরাকোটার ফলক আছে। তাঁর এক হাতে চামর। রঙের প্রলেপে আকৃতি ঠিক বোঝা যায় না। এটি বৌদ্ধ তন্ত্রের কোন মূর্তি কিনা অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে।
আমরা ছোট বেলায় গেঁড়ি বুড়ির জাত দেখতে যেতাম দাদা কাকার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে। আমাদের গ্রামে তখনো তিনটি মাত্র সাইকেল। কাল মাস্টার বাদলবাবু আর হরি রক্ষিতের। গ্রামে কোন রেডিও ছিল না। ৬০-৬৫ বছর আগে আমাদের ছোট বেলায় মেলাতে আসতো ঘুনি মুগরি পাং ঝেঁপো বাড়, সেউনি তথা সেমনি ধুচুনি খালুই চ্যাঙারি, ঠ্যাকা, তালপাতার পেখ্যা, কুলো, চালুনি, চুবড়ি, ঝড়া। এগুলো মূলত তৈরি করত ডোমেরা। আর এর সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে আসতো বেতের বোনা ছোট বড় মাঝারি ধামা ,বাগি কাঠা কঁচা পুয়া দাঁড়িপাল্লার পাল্লা। বেতের জিনিস বানাত মুচি তথা চর্মকারেরা। এরাও বসতো মন্দিরের পশ্চিম দিকে দিঘির দক্ষিণ পাড়ে একটা বট গাছের তলায় আর দেবদারু গাছের ছায়ায় দিঘির পূর্ব পাড়ে। মন্দিরের পূর্ব দিকে পাওয়া যেত সস্তায় বেটাদড়ির চাটুনি জাল, সুতোর বেশি দামের চাটুনি জাল, মাথা ঘুরানি জাল গাব দিয়ে কালো রং করা; এমনি সাদা, বাঁশের মাথায় বেঁধে সারে সারে ঝুলে থাকতো ক্রেতার আশায়। গাঁতি জাল ঘাট গাঁতি, মরুলা গাঁতি, লাফাতে পাতার জাল, ফেটা জাল, বিভিন্ন মাপের ছিপ, হুইল ডোর বঁড়শি তথা মাছ ধরার কাঁটা জালসুতো। গাছের কলম পাওয়া যেত রাস্তার দুপাশে। বেশি আসতো লেবুর কলম এছাড়া আসতো আমের কলম ,চাঁপা ফুলের গাছ গোলাপ কলম তেজপাতা গাছ আরো টবে টবে নাম না জানা কতকি গাছ। মনোহারি দোকান ও আসতো। কাঁচের চুড়ি আসতো বেশি। মনোহারি দোকানে আমাদের সাধ্যের মধ্যে কিনতাম রাবারের বল কাঁচের গুলি পাথরের গুলি লাট্টু তালপাতার সেপাই টিনের ব্যাঙ কটকটি সস্তার মাউথ অরগান আড় বাঁশি টিনের হুইসেল কাগজের কুমীর এই সব। দু চারটে বইও থাকতো দোকানগুলোতে। প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ ধারাপাত গাছ গাছড়ার উপকার ম্যাজিক শিক্ষার বই ইত্যাদি। কাকা হাজার অনুরোধেও ম্যাজিকের বই কিনে না দিয়ে পিন আঁটা কোকশাস্ত্র কিনে ছিল সে দুঃখ আজও ভুলতে পারিনি। লোহার জিনিসের দোকান থাকতো দুটো একটা। মন্দিরের সামনে রাস্তার ওপারে থাকতো মিষ্টির দোকান। কলাইকরা থালায় থালায় সাজানো থাকতো উজ্জ্বল লাল রঙের লবঙ্গ লতিকা। লবঙ্গ গুলো সামনে গোঁজা থাকতো। নানা রঙের জিভে গজা, গুড়ে মাখামাখি ব্যাসমের শুঁটিভাজা গুড়ের আংটি জিলিপি বড়ো জিলিপি, চিনির জিলিপির দাম বেশি ছিল। তেলকিটানি গন্ধ যুক্ত কালো জিরে দেওয়া চিনি চটচটে খাস্তা গজা বারকোশে সাজানো থাকতো সামনে। পাশেই থাকতো নিমকির চুবড়ি যেটা তেলে চুবচুব করতো। আধখানা কাটা হলদে রঙের উপর কালো রঙের দুটো হাতি আঁকা তেলের টিনে ভাসতো পান্তুয়া রসগোল্লা রঙিন মুগের জিলিপি। টোকো রসগোল্লা থেকে তৈরি শক্ত ইঁটের মতো চারকোণা ছানার সন্দেশ টকে যাওয়া রস মেরে তৈরি গোল গোল বামুন মারা চিনির ডেলা সন্দেশ বাতাসা আর চিনি মাখামাখি উপর শুকনো ভেতরে রসে টুবটুব গোলাপি রঙের দানাদার। বহু দূর থেকে তেলে ভাজার গন্ধে আমার বুঝতে পারতাম জাত আর দূরে নেই। তেলে ভাজার দোকান বসতো অনেকগুলো। চপ বেগুনি পেঁয়াজি ফুলুরি বোমা পাঁপড় সব ভাজা হত সরষের তেলে। তার গন্ধ ভোলার নয়। শালপাতা বা কলাপাতায় মুড়ে খোদ্দেরের হাতে তুলে দিতেন দোকানদার। সাজা পান বিড়ির দোকান বসতো। টিনের খোপে খোপে সাজিয়ে রাখা থাকতো কত রঙিন মশলা। একটা মিষ্টি রঙিন রসে ডুবিয়ে পিফারমেন্ট দেওয়া পান তুলে দেওয়া হত ক্রেতার হাতে। নারকেল ছোবড়ার দড়িতে আগুন জ্বলতো।বিড়ি ধরিয়ে খেত মানুষ ঐ আগুন থেকে। তখনও মেলাতে ঘুগনি বা ডিম সিদ্ধ বিক্রি হত না। ঘুগনি কী জানতাম না। ফুচকার নামও শুনিনি। আইস ক্রিম বিক্রি হত খুব। আমরা আইসক্রিমের কাঠি চুষে মিষ্টি বের করে নিতাম।
নির্ভয়পুরের পটিকাররা কাঁচা রঙের গন্ধ মাখা দাঁড়ে বসা দুটো পাখি , ছেলে কোলে মা, নাক চ্যাপ্টা হাত পা হীন পুতুল, ছাঁচে গড়া পোড়া মাটির লক্ষ্মী ঠাকুর ঝড়ায় করে নিয়ে বসতো। রঙকরা হাত পা হীন কাঠের পুতুল আসতো যা ভেঙে ফেলা দুষ্ট ছেলে তো কোন ছার, ছেলের বাপেরও অসাধ্যি ছিল। পাখা বিক্রেতা একটা ছ সাত ফুট বাঁশের খাঁজে খাঁজে তালপাতার হাত পাখা গুঁজে সারা জাত ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতো। কোন পাখা সাপটা কোনটা ঝালর দেওয়া রঙিন। আড় বাঁশি বাজিয়ে বাঁশি বিক্রি করতো বাঁশিওয়ালা। বিক্রেতার মতো বাঁশি বাজিয়ে হওয়ার লোভে ঝিলাপি (জিলিপি)কেনার পয়সায় বাঁশি কিনে বংশীবাদক হতে পারিনি। কলের গান বাজানো সিনেমা বক্স আসতো জাতে। পয়সা দিয়ে ঢাকনা সরিয়ে গোল ঘুলঘুলিতে চোখ রাখতাম। এক স্বপ্ন জগতের সম্মুখীন হতাম। রেকর্ড যতক্ষণ বাজত নির্বাক দেবদেবী নায়িকা নায়ক একটার পর একটা চোখের সামনে দিয়ে চলে যেত। সে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। আসতো বেলুন ওয়ালা। জাতময় ঘুরে ঘুরে বেলুন বিক্রি করতো। লম্বা বেলুনে ফুল করা রাজ মুকুট পরে সারা জাত ঘুরে বেড়াতাম। লম্বা বেলুন ছাড়া অন্য গুলো খুব কম বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারতো আর এলেও দাপাদাপিতে দুম ফটাস হত অল্প কিছু সময়ের মধ্যে। ছেঁড়া বেলুনকে ছোট ছোট বেলুন তৈরির চেষ্টাতে বেশ কিছুটা সময় কেটে যেত আমাদের।
হাতে ঘুনি কাঁধে চাটুনি জাল ঝুলিয়ে ব্যাঙ কটকটি বাজাতে বাজাতে দিগ্বিজয়ী বীরের মতো বাড়ি ফিরে আসতাম। শরতের আকাশে সিঁদুর লেপে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা সবুজ ধান বাড়ির শেষে সুয্যি ঠাকুর অস্ত যেতেন।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!