‘ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি’ —উমাশংকর নিয়োগী
•ভারতের স্বাধনীতা প্রাপ্তির ইতিহাস জানতে গেলে, সন্ধে প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্টের একটু আগে থেকেই শুরু করা যেতে পারে। ইতিহাস কেবল সন তারিখ ঘটনার বিবরণ মাত্র নয় বিশ্লেষণও । প্রতিটি ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের কার্য কারণ সঠিক ভাবে না জানলে ইতিহাস জানা হয় না। হঠাৎ করে যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি , তা ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ঘটনার ক্রম পরিণতির ফল সেটাই তুলে ধরার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থাকবে এই নিবন্ধে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ ২৩ শে জুন বৃহস্পতিবার । ভাগীরথী নদী তীরে পলাশী রণক্ষেত্র। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার প্রতিপক্ষ ইরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধ হল। নবাবের পদাতিক , অশ্বারোহী, ৫৩টি কামান মিলিয়ে ৫০০০০ সৈন্য ছিল। ক্লাইভের সৈন্য ছিল ইউরোপীয় ১০০০, এ দেশের সিপাই ২১০০, বন্দুকধারী ১০০ এবং কামান ৯টি। যুদ্ধের সময মীর জাফর , ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভরাম, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ প্রমুখের বিশ্বাস ঘাতকতায় এঁদের অধীনস্থ ৪৫০০০ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নবাবের মাত্র ৫০০০ সৈন্য যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে সিরাজদৌল্লা বিশাল সৈন্য বিহিনী থাকা সত্ত্বেও পরাজিত ও নিহত হলেন,ষড়যন্ত্রকারীদের জয় হল। এর পরে বাংলার মসনদে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতের পুতলরা বসতে শুরু করে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে চুক্তি বলে বাংলার দেওয়ানি লাভ করল । বাংলার আভ্যন্তরীণ শাসন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হল ইংরেজদের হাতে। কাজ হারাল জমিদারদের অধীনস্থ পাইকরা। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিরোধী পাইকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ জন্ম নেয়। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করে। ইতিহাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে খ্যাত। মেদিনীপুরের ক্ষীরপাইয়ে এই বিদ্রোহ দমন করতে এসে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড পর্যুদস্ত হয়েছিলেন। ক্রমে ছলেবলেকৌশলে ভারতের শাসন কর্তা হয়ে বসল ইংরেজ। কিন্তু ভারতের মানুষ বিক্ষিপ্ত ভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ করে গিয়েছে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল।সমস্ত জমিদাররা ইংরেজদের শাসন ভূক্ত হল। সমস্ত নিষ্কর জমির উপর কর বসল। নিষ্কর জমি হারাল পাইকরা। তাদের জমির উপর চাপল কর। কাজ হারিয়ে এবং জমির খাজনা দিতে বাধ্য হয়ে বিদ্রোহী পাইকরা লুঠপাট শুরু করল। তাদের বিদ্রোহ দমন করতে আসা ইংরেজদের সঙ্গে দুঃসাহসী পাইকরা অসীম বীরত্ব নিয়ে লড়তে শুরু করে। ১৭৯৮ – ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের এই পাইক ও কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে চুয়াড় বিদ্রোহ নামে সবাই জানে।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুন ভাগলপুর জেলার ভগনাডিহির মাঠে প্রায় ১০০০০ সাঁতাল আপন অধিকার আদায়ের সংকল্প নিতে জমায়েত হয়। সিধ, কানু , চাঁদ ও ভৈরব মুর্মু এই চার সহোদর ভাইয়ের নেতৃত্বে শাসক ইংরেজ ও শোষক বাঙালি মহাজন দিকুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অনেকে মনে করেন ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচার, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে এটাই ভারতে প্রথম সশস্ত্র গণবিদ্রোহ; স্বায়ত্বশাসন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে মুক্তিযুদ্ধ।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ তথা ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচনা পর্ব অনেক ঐতিহাসিকের কাছে কেবল সিপাহি বিদ্রোহ। দেশীয় সৈন্যের সঙ্গে ইরেজ সৈন্যের বেতন ও পদ বৈষম্য, ইংরেজ অফিসারদের ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার, সেই সময় এনফিল্ড রাইফেলের টোটা দাঁত দিয়ে কেটে রাইফেলে ঢোকাতে হত, টোটাতে চর্বির ব্যবহার , স্বত্ববিলোপ নীতি, ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া হিন্দু ,মুসলমানদের পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নতুন আইন, হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খ্রিস্টান যাজকদের নিন্দা, অপপ্রচার, নতুন ভূমি রাজস্বনীতির ফলে কৃষকদের আরো দরিদ্র হয়ে পড়া ইত্যাদি বহুবিধ কারণে এই মহাবিদ্রোহ হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে মার্চ ব্যারাকপুর সামরিক ছাউনির বিক্ষুব্ধ মঙ্গল পাণ্ডে গুলি চালিয়ে কয়েক জন ইংরেজ সামরিক অফিসারকে হত্যা করার চেষ্টা করে । দ্রুত বিচার করে মঙ্গল পাণ্ডেকে ৮ই এপ্রিল ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতের সামরিক ছাউনিগুলিতে খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। মিরাটের সামরিক ছাউনিতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মে সংগঠিত সিপাই বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের আগুন বহু সামরিক ছাউনিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী সৈন্যরা দিল্লি দখল করে মসনদচ্যুত মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের বাদশা বলে ঘোষণা করে। কিন্তু গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং তৎপরতার সঙ্গে এই বিদ্রোহ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুনের মধ্যে দমন করেন। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়াকোম্পানির শাসনের অবসান হয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের শাসন কায়েম হয়।
মহাবিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটতে না ঘটতে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার কৃষকরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহকে আমরা সবাই নীলবিদ্রোহ বলে জানি। যশোহর জেলার চৌগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নামে দুই বিক্ষুব্ধ চাষী নীলচাষ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। পরে পরে এগিয়ে আসেন কাদের মোল্লা রফিক মণ্ডল প্রমুখ কৃষকরা। নীলবিদ্রোহের নেতৃত্বে মূলত এই চারজন ছিলেন। এই বিদ্রোহ ছিল সারা বাংলার কৃষক বিদ্রোহ। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই অংশ নিয়েছিলেন এই বিদ্রোহে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠিত হয়। নীলবিদ্রোহের অবসান হল ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলার শিক্ষিত সমাজ চাই ছিলেন সারা ভারতব্যাপী সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের একই পতাকা তলে আনতে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গড়ার প্রস্তাব তুলেন। পরে এই সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে কলকাতাতেও একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এসব কর্মতৎপরতা দেখেশুনে বড়লাট ডাফরিন অবসর নেওয়া আই সি এস এ্যালন অক্টোভিয়ান হিউমের উপর কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দিলেন। হিউম সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,আনন্দমোহন বসু প্রমুখ নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে পরিকল্পনার পূর্ণরূপ দিলেন। অবশেষে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল । সভাপতি হলেন ব্যারিস্টার উমেশচ্ন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস গঠনের সময় মুসলমান নেতাদের তরফ থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা আসেনি।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেন। মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার সমাজে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের মনে সরকারি সুযোগ সুবিধা বেশি করে পাওয়ার আশা সঞ্চারিত হয়। নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করলেন। কিন্তু কংগ্রেস এবং হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের চরম বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে। প্রচণ্ড হতাশ হল মুসলমানরা। কংগ্রেস থেকে মুসলমানরা আরও বেশি দূরে সরে যেতে থাকে, হিন্দুদের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়তে থাকে। মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ এই অবস্থায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং সরকারের কাছে তাদের দাবি পেশ করতে সংঘবদ্ধ হয়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের কথা চিন্তা করেন। এর ফল স্বরূপ, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে ডিসেম্বর ঢাকা শহরের শাহবাগে নবাব সলিমুল্লাহ, জাফর আলি খান প্রমুখ নেতাদের সহযোগিতায় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ‘ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন আগা খান। কংগ্রেসের লাগাতার আন্দোলনের ফলে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। হিন্দুরা খুশি হয় মর্মাহত হয় মুসলমানরা।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে তৎকালের সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেক প্রজাতন্ত্রের তাসখন্দ শহরে মানবেন্দ্রনাথ রায়, মহম্মদ শাফিক , মাণ্ডয়ন পার্থ সারথি, তিরুমল আচার্য প্রমুখ কয়েকজন সদস্য নিয়ে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর ভারতের কমিউনিস্টপার্টির জন্মলাভ করে। দলের প্রথম সম্পাদক হন মুহম্মদ শাফিক। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বহারাদের যে বিপ্লব হয়েছিল তার প্রভাব যাতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কোনোমতেই না পড়ে তার জন্য খুবই সতর্ক ছিল ব্রিটিশ প্রসাশন। কিন্তু কলকাতা থেকে মুজফ্ফর আহমদ, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ,শামসুল হুদা প্রমুখের নেতৃত্বে সারা ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলন শুরু করে।
বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনের সময় থেকে কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে নরম পন্থী ও চরম পন্থী এই দুটো ভাগ লক্ষ করা যায়। ভারতীয় কংগ্রেসের চরম পন্থী তথা উগ্রপন্থীরা ব্রিটিশ বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে তোলেন ইতিহাসের ভাষায় তা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত। কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকগণ বিলাতি পণ্য বর্জন, প্রকাশ্যে বিলেতি জিনিস পুড়ানো, স্বেদেশী জিনিস ব্যবহার, লবণ তৈরি করা ইত্যাদি শুরু করেন। এই আন্দোলন গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। স্বেদেশী আন্দোলনকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ ,রজনীকান্ত,অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল অনেক দেশপ্রেম মূলক সঙ্গীত রচনা করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা তুরস্কের খলিফা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের খলিফা জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর প্রতিশোধ নিতে মিত্রপক্ষ তুরস্ককে খণ্ড বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল । খলিফার মর্যাদা ও তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতের মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলে। এই আন্দোলনটি আমাদের কাছে ‘ খিলাফত আন্দোলন ‘ নামে সুপরিচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মহাত্মা গান্ধি ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়েছেন এবং সর্বত ভাবে তাদের সাহায্য করেছেন। অথচ ব্রিটিশ প্রসাশন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের চেষ্টা ,সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ,মন্টু চেমসফোর্ডের নৈরাশ্যজনক সংস্কার আইন , রাওলাট আইন ইত্যাদি ভারতীয়দের হতাশ করে ।গান্ধিজি রাওলাট আইনের তীব্র প্রতিবাদ করে দেশব্যাপী অনশন ধর্মঘট ডাকেন। এই প্রতিবাদ আন্দোলনের চরম পরিণতি ঘটে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যা কাণ্ডে। জেনারেল ডায়ার নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে ৩৭৯ জনকে হত্যা করেন। অমৃতসরের এই হত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘ অসহযোগ আন্দোলন’ এর ডাক দিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন ভারতে গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। ঐ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দেই চৌরিচৌরা নামক স্থানে এই অহিংস আন্দোলন সহিংস রূপ নিলে গান্ধিজি এই আন্দোলন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেন।
স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা স্বাধীনতাকামী যুব সমাজের এক অংশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সশস্ত্র সংগ্রামের সাহায্যে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের গোপন তৎপরতা শুরু হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড় স্টেশনের অদূরে রেল লাইনে বাংলার ছোটখাট এন্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার জন্য বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীরা বারীন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিযেছিল। এখান থেকে বিপ্লবীদের প্রকাশ্য কর্ম তৎপরতা শুরু হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ক্ষুদিরাম বসু বোমা ছুঁড়েন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিপ্লবীদের কর্মতৎপরতা সক্রিয় ছিল। মিঃ বার্জ, মিঃ পেডি,মিঃ ডগলাস হত্যা, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল ইত্যাদি ঘটনা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । বিনয়- বাদল -দিনেশ , অরবিন্দ ঘোষ ,প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, প্রভাংশুশেখর পাল, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শতশত বীর বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন।
কংগ্রেসের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘ স্বরাজদল ‘ গঠন করেন। হিন্দু মুসলমানের সমতার লক্ষে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট ‘ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ের ‘নেহেরু রিপোর্ট ‘ মুহাম্মদ আলি জিন্নাহের ‘ চোদ্দ দফা ‘ ‘ সাইমন কমিশন ‘রিপোর্ট ‘ লন্ডনে অনুষ্ঠিত তিনটি ‘ গোল টেবিল বৈঠক ‘ কোনটাই রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পারল না। অবশেষে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ভারত শাসন আইন ‘ গৃহীত হয়।১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয় লাভ করল। এর কিছুদিন পরেই বেশ কয়েকটি রাজ্যে হিন্দু মুসলমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা জিন্নাহ এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের বার্ষিক সভায় মুসলমানদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রস্তাব রাখেন এবং তা সভায় গৃহীত হয়।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। ‘ক্রিপস মিশন’ প্রস্তাব কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। গান্ধিজির ডাকা অসহযোগ আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । ভয় পেয়ে গান্ধিজি, জওহরলাল নেহেরু, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতাকে কারা বন্দী করে ইংরেজ সরকার। এতে সারা ভারত ব্যাপী নেতৃত্ব হীন স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলনে উত্তাল হয়।কংগ্রেস বে আইনি ঘোষিত হল। তমলুক থানা দখলের সময় মাতঙ্গিনী হাজরা গুলি বিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। কিছু দিনের জন্য তমলুকে স্বাধীন জাতীয় সরকার গঠিত হয় ।
এই সময়ে দেশের মানুষ যখন স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়ে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিল তখন বিদেশে থেকে রাসবিহারী বসু যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিতা করলেন ‘ আজাদ হিন্দ ফৌজ ‘ । এক সময়ের কংগ্রেসের সভাপতি ,ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠিতা সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে গৃহবন্দী থাকা অবস্থাতে গোপনে ইংরেজদের শত্রু দেশ জার্মানিতে চলে যান। বিদেশী সামরিক শক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের চেষ্টা করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভূখণ্ডের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার গঠিত হয়। এই অসম সাহসী বাঙালি সামরিক নেতার সুদক্ষ পরিচালনায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মা হয়ে মূল ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোহিমা, ইম্ফল প্রভৃতি রণাঙ্গনে সাফল্য অর্জন করে। ইংরেজদের কাছে ত্রাসের কারণ হয়ে ওঠে আজাদ হিন্দ বাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর জয়, জাপানের রেঙ্গুন ত্যাগ ইত্যাদি কারণে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতকে স্বাধীন করতে ব্যর্থ হয়। দুঃসাহসী বাঙালি দেশপ্রেমিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টা সফল হলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে লিখতে হত।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সামরিক অভিযান ব্যর্থ হলেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এর প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দেশীয় সৈন্যের মনে রাজভক্তিতে ফাটল ধরে ছিল। স্বাধীনতাকামী মানুষকে সাহস শক্তি যোগিয়ে ছিল। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে নৌবাহিনীর বিদ্রোহ এরই ফলশ্রুতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি জয় লাভ করে। ভারতকে স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে লেবার পার্টি নমনীয় মনোভাব পোষণ করত। ইংল্যান্ডের নব নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী এ্যাটলি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেন। এই নির্বাচনে বাংলায় মুসলিমলীগের প্রগতিশীল নেতা সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে সাফল্য পায়। পরোক্ষ ভাবে বাংলার মুসলমান মুসলমানদের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব সমর্থন করে।
ভারতে নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থতি দেখে বিচক্ষণ এ্যাটলি সরকার বুঝতে পারে তাদের পক্ষে মানসম্মান নিয়ে আর বেশি দিন ভারত শাসন সম্ভব নয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারত সচিব প্যাথিক লরেন্সের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ভারতে আসে। এই প্রতিনিধি দল কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ভারতের ভবিষ্যত সংবিধান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করে। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বড় লাট ওয়েভেলের আহ্বানে কংগ্রেসের নব নির্বাচিত সভাপতি জওহরলাল নেহেরু সরকার গঠন করতে চাইলেও মুসলিমলীগের সদস্যরা চরম বিরোধিতা করে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এর আহ্বান জানায়। এই দিনের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরীহ হিন্দু মুসলমান নিহত হয়। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চরম অবনতি হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলি ঘোষণা করেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের আগেই ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ভারতের বড় লাট হয়ে এলেন লর্ড মাউন্টব্যাটন। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে লর্ড মাউন্টব্যাটন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জুন ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হাউস অব কমন্স সভা ঐ বছরের ১৫ ই জুলাই ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের ভার ন্যস্ত হয় রাডক্লিফের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির উপর তিনি আগস্টের ৯ তারিখে রিপোর্ট পেশ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই ‘ ভারত স্বাধীনতা আইন ‘ প্রণয়ন হয়। এর ভিত্তিতেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই আগস্ট পাকিস্তান জন্ম নেয়।
অবশেষে এল বহু প্রতিক্ষীত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ ১৪ ই আগস্টের মধ্য রাত্রি। লালকেল্লা থেকে বড় লাট মাউন্টব্যাটন ‘ ইউনিয়ন জ্যাক ‘ নামিয়ে নিলেন, ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতের জাতীয় পতাকা তুললেন জওহরলাল নেহেরু। প্রায় দুশো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন হল ভারতের। দেশমাতৃকার ত্রিখণ্ডিত দেহের এক অংশ নিয়ে জন্ম নিল স্বাধীন ভারত। কারাগারের অন্তরালে যে সব দেশপ্রেমিক কেবল দেশকে ভালোবাসার অপরাধে মুক্তির দিন গুনতি করছিলেন তাঁদের প্রহর গোনা শেষ হল। শতশত শহিদের রক্ত, দেশপ্রেমিকের ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত হল স্বাধীনতা ।
স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষ হলেও সব সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। এখনকার লড়াই আরো কঠিন লড়াই । ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভায়ের লড়াই। সাম্প্রদায়িকতা, অপসংষ্কৃতি, অন্ন বস্ত্র, শিক্ষা , স্বাস্থ্য, জীবিকা অর্জনের লড়াই জারি আছে দেশে। যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীগণ তা আমরা পূর্ণ করতে পারিনি। ভারত এখন বিশ্বের সর্ব বৃহত গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস, ধর্মীয় বিদ্বেষ ,পেশি শক্তির আস্ফালন, অশিক্ষা, দুর্নিবার লোভ , দুর্নীতি, অপশাসন ,স্বজন পোষণ ইত্যাদি সহ নাগরিকগণের এই সমস্ত বিষয়ে নির্লিপ্ত মনোভাব দেশের সমূহ বিপদ ডেকে আনছে। সচেতন না হলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আবার বিপন্ন হবে । আমাদের বিস্মৃত হওয়া চলবে না।
মোহিনী চৌধুরীর ভাষায় –
” কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা –
বন্দীশালায় ঐ শিকল ভাঙা
তারা কি ফিরিবে আর সুপ্রভাতে।
কত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে-
ঐ মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রু জলে। “