মোনালিসা বেরা, ‘স্থানীয় সংবাদ’, ঘাটাল: ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি বিদ্যালয় মানে বিদ্যার আলয় অর্থাৎ যেখানে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আনাগোনা। কিন্তু বর্তমানে সেই বিদ্যালয়ে সরস্বতীর থেকে লক্ষ্মীর আনাগোনাই বেশি। বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন শুধুই টাকার খেলা। বিদ্যা আজ যেন পণ্য। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে শিক্ষা। এই বিদ্যা নামক পণ্যটিকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার মুনাফা লুটছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ (বিএড ও ডিএলএড) কলেজগুলিও। এনসিটিই (NCTE) এর নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষকতার পেশায় বর্তমানে বিএড ও ডিএলএড বাধ্যতামূলক হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে
টাকার খেলা চলছে রমরমিয়ে।
এরসাথে আজ ইন্টার ন্যাশনাল স্কুলগুলি সহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে, ভারতে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হলেও সমাজে ধনী মানুষ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সকলেই তাদের সন্তানদের উন্নতির আশায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকেই ঝুঁকছেন। দেখাদেখি সমাজের মধ্যবিত্ত ও সরকারি কর্মচারীরাও তাদের আয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সন্তানের উন্নতির নেশায় মশগুল হয়ে অবিবেচকের মতো সেদিকেই ছুটে চলেছেন। যদিও দেখা যায়, যে অনেক নামকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষক তথা পড়াশোনার মান আশানুরূপ নয়। ছেলেমেয়েদের উন্নতি পিপাসু
এই মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষদের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগুলির চড়া মাসিক ও বাৎসরিক ফিস এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে। এর প্রভাব প্রত্যক্ষ ভাবে পড়ছে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপরও। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, অনেক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ অবলুপ্তির পথে।
তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, বর্তমান সমাজে গরিব হওয়া নিতান্তই অপরাধ। গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার যেন কোনও অধিকারই নেই। অনেক সময় অর্থের অভাবে মেধার সাথে আপোষ করাটা খুবই কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। জয়েন্ট এন্ট্রান্স, ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও কেবলমাত্র অর্থের অভাবে একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীর স্বপ্ন পূরণ হয় না। অন্যদিকে কেবল অর্থের জোরে সেভাবে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কেউ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যান। এইভাবেই সমাজে তৈরি হয় চরম বৈষম্য। কষ্ট হয় যখন দেখি আমারই পরিচিত কোনও একজনের কেবলমাত্র সেমিস্টার ফিস দিতে না পারার কারণে রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়। শত অনুরোধেও শিক্ষাকে পণ্য বানানো এই লোভী মানুষগুলোর হৃদয় গলে না। প্রতিবছর আমাদের দেশে কেবলমাত্র অর্থের অভাব স্বপ্নপূরণ না হওয়ার
কারণে অবসাদে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন অনেকে। এমনটা মোটেও কাম্য নয়। এছাড়াও এখন কলেজগুলিতে একই শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ইচ্ছা মতো ফিস আদায়েরও ভুরিভুরি অভিযোগ শোনা যায়।
ইতিহাস স্বাক্ষী আছে, বেসরকারি শিক্ষা আমেরিকা সহ পৃথিবীর কোথাওই সেভাবে সফল হয়নি। এমনকি চীনেও সরকারি শিক্ষককেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির এইরকম রমরমা কারবার মোটেও অভিপ্রেত নয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে অর্থের লেনদেনের উপর রাশ টানা একান্তই প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপ ও কঠোর আইনের। সর্বাপেক্ষা সমাজের সমস্ত অভিভাবক ও শিক্ষার সাথে যুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় একান্ত ভাবেই আবশ্যক। তবেই বাঁচবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম, গুরুত্ব পাবে মেধা, মজবুত হবে দেশের ভিত্তি এবং নিস্ফল হবে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে রাখা অর্থলোভী মানুষদের অশুভ অভিপ্রায়।