দেবাশিস কুইল্যা: ইতিহাস, বৃহত্তর অতীতের কথা পাঠ্যপুস্তক আর গবেষণাপত্রের সীমানায় আবদ্ধ থেকে যায়। বৃহত্তর ইতিহাসের গভীরে গেলেই বুঝতে পারা যায় হাজারও হাজারও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক একটা জাতি ও দেশের ইতিহাস। সেই ইতিকথার উপর ভর করেই পৌঁছে যাওয়া যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনার অন্তঃস্থলে। তেমনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ হিসাবে এক ঘটনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানায় চেঁচুয়া হাটে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ২৩ জৈষ্ঠ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের যুপকাষ্ঠে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে চোদ্দ জন স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মবলিদানের কাহিনী। সে ইতিকথার ঘটনা ঘটে যাওয়ার কারণ হিসেবে ঘাটাল মহকুমা জুড়ে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর জলপথে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম।
দাসপুর থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কংসাবতীর পূর্বপাড় ও পলাশপাই খালের দক্ষিণপাড়ে আনুমানিক ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে চেঁচুয়ার হাট গড়ে উঠল। চেঁচুয়াহাটকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে স্বদেশিকতার ঢেউ আছড়ে পড়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ও ঘাটাল মহকুমা তথা সমগ্র দেশের সাথে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় বাঙালি যখন নিজেদের একটি জাতি হিসাবে চিন্তা করতে লাগল তখন থেকেই তার উত্তাপ সমৃদ্ধ করেছে দাসপুর তথা ঘাটাল মহকুমার জনপদ। ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের পর কয়েকজন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তুলে মহকুমার বিভিন্ন জায়গায়। মহাত্মা গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে মেদিনীপুর জেলার কংগ্ৰেসের সহকারী সভাপতি রাধাকান্তপুরের মোহিনীমোহন দাস ও তাঁর পুত্র স্বদেশরঞ্জন দাস সোনাখালি, নন্দনপুর, শ্যামগঞ্জ, চেঁচুয়া, তেমুহানি, ধানখাল সহ বিভিন্ন জায়গায় গুপ্ত সমিতি ও স্বেচ্ছাসেবী দলকে আরও শক্তিশালী করেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী দলের পুরভাগে থাকা যোগেন হাজরা, বিনোদবিহারী বেরা, কাননবিহারী গোস্বামী, অরবিন্দ মাইতি, মন্মথনাথ চক্রবর্তী, মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যদের অগ্ৰণী ভূমিকায় অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিনা লভ্যাংশে স্বদেশি জিনিস বিক্রির ব্যবস্থা ও প্রচার করা হয় চেঁচুয়ার হাটে। এর মধ্যে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের গান্ধীজির লবণ সত্যাগ্ৰহ, আইন আমান্য আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলে চেঁচুয়াহাট কেন্দ্রীক আশেপাশের গুপ্তসমিতিগুলিতে। কারণ হিসাবে রূপনারায়ণ নদীর জোয়ার বাহিত নোনাজল হতে লবণ তৈরির উপযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান শ্যামগঞ্জ আর উৎপাদিত লবণ বিক্রয়ের মূল কেন্দ্র চেঁচুয়ার হাট। এই সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় কংগ্রেস কমিটি স্বেচ্ছাসবক বাহিনী পাঠিয়ে শ্যামগঞ্জে লবণ প্রস্তুতের ঘাঁটি স্থাপন করে। ৭ এপ্রিল থেকে লবণ তৈরি চলতে থাকলো আর তা চেঁচুয়ার হাটে স্বদেশি ও স্বেচ্ছাসেবক দল বিক্রির সাথে সাথে স্বদেশি জিনিস ব্যবহার ও বিক্রয়ের অনুরোধ করতে থাকে। তার সাথে হাটে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের বিদেশি লবণ, চিনি, কাপড় আমদানি ও বিক্রি বন্ধের অনুরোধ করলেও তাতে তারা কর্ণপাত করেনি নিজেদের লোকসানের কথা চিন্তা করে। পরন্তু স্বেচ্ছাসেবক দলের অজান্তে তাদের কাজের খবর পৌঁছে যেত ব্রিটিশ পুলিশের কাছে।
এমনই এক হাটের দিন ৩ জুন ১৯৩০, বাংলার ২০ জৈষ্ঠ্য ১৩৩৬ মঙ্গলবার স্বদেশিরা বিলেতি কাপড়ের সাথে বিদেশি জিনিস বিক্রি ও ব্যববহার বন্ধের পক্ষে প্রচার করেছিল। সেই দুপুরে দাসপুর থানার বড়বাবু ভোলানাথ ঘোষ ও তার সহকারী অনিরুদ্ধ সামন্ত চারজন সিপাই নিয়ে হাটে পৌঁছে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন। হরি নন্দীর দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে থাকা ইচ্ছাকৃতভাবে বড়বাবুর নাম ধরে ডাকা ও একই বেঞ্চে তার পাশে মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বসলে অপমানিত দারোগাবাবু হাতের বেত নিয়ে মৃগেন্দ্রনাথকে প্রহার করেন। সাহসী মৃগ্ৰেন্দ্রনাথও দারোগার বেত কেড়ে ওই বেত দিয়েই প্রতিশোধের উপযুক্ত বেত্রাঘাত ফিরিয়ে দেন। তা দেখে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে, রাতে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় ডোমনার পুকুর পাড়ে মাটিচাপা দিয়ে কলাগাছ লাগিয়ে দেয়। অন্যদিকে নিবারণ মাজির কাপড় দোকানে লুকিয়ে থাকা অনিরুদ্ধ সামন্তকে দোকান থেকে বাইরে এনে স্বদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হলে ওইদিন রাতে চকবোয়ালিয়ার চিৎমল্লিক পুকুর পাড়ে টুকরো টুকরো করে কেটে সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেহাংশগুলো। বাকি চার সেপাইকে নিয়ে সুধাংশু ঘোষ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে নিজের বাড়িতে যান। সুধাংশুবাবুর বাবা জমিদার দেবেন্দ্র ঘোষ ও চার কনস্টেবলের আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় বিশ্বস্ত কর্মচারী দিয়ে সন্তর্পণে বাড়ির বাইরে এনে মলিঘাটির ঘাটে ছেড়ে দিয়ে এলে তাঁরা নদী পার হয়ে মেদিনীপুর পৌঁছায়।
৩ জুন অর্থাৎ ২০ জৈষ্ঠ্যের ঘটনার কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গ্ৰামান্তরে। পরেরদিন ৪ জুন দুপুরের পর তদন্তে এলেন মেদিনীপুরের ডি.এম মি. পেডি, এ.ডি.এম আব্দুল করিম আর দাসপুর থানায় নব নিযুক্ত দারোগা ইয়ার মহম্মদ। সেই সূত্রে চেঁচুয়ায় বসল পুলিশ ক্যাম্প আর আশেপাশের এলাকায় চলল অকথ্য পুলিশি অত্যাচার।
৬ জুন ১৯৩০ শুক্রবার: দশহারা, জলপথে আরও পুলিশ ও সেপাই আসার খবর মেয়েদের শঙ্খধ্বনির মধ্যদিয়ে আশেপাশের গ্ৰামে ছড়িয়ে পড়লে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে চেঁচুয়া হাটের বিপরীতে পলাশপাই খালের উত্তরপাড়ে জমা হতে থাকে। স্লোগান দিতে দিতে এগোতো থাকে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আর পুলিশ ক্যাম্প তুলে নেওয়ার দাবিতে। পুলিশের আদেশ অমান্য করে পলাশপাই খাল অতিক্রমে প্রস্তুত হলে পুলিশের গুলিতে ১৪ জন নিহত ও ১৪৫ জন আহত হয়। এতদসত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ভয় না পেয়ে অগ্ৰসর হলে পুলিশবাহিনী পলাশপাই খালের খাসিকাটা ঘাট অতিক্রম করে জলপথে কংসাবতীর মধ্যদিয়ে পিছু হটে।
এরপরের ঘটনা ইতিহাস। শুধুই ইতিহাস। প্রত্যক্ষদর্শীদের উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যাওয়া বর্ণনা তৎকালীন সময়ে স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোর জন্য তর্পণ। সেই তর্পিত বর্ণনা দেশ স্বাধীনের পর ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। শুধু দেশ স্বাধীনের আকাঙ্খায় একদিনেই এক জায়গায় ১৪ জন প্রাণ দিতে পারে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে সে ঘটনা একটা জেলা বা রাজ্য শুধু নয় সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দেওয়ার ঘটনা। যেখানে সুনন্দ সেন, ব্যারিস্টার বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, শরৎচন্দ্র বসু, অ্যাডভোকেট সাতকড়ি রায়, বরদাপ্রসন্ন পাইন, জমিদার দেবেন্দ্রলাল খাঁ, সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতৃত্বগণ বিভিন্ন ভাবে সাহয্য করেন মামলায় স্বদেশিদের সাহায্য করেন, ঘটনা সাধারণ ঘটনা বা আন্দোলনের মধ্যে ছিল না। প্রতি বছর সময়ের হিসেব অনুযায়ী ৬ জুন আসে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে দাগ কেটে যাওয়া ঘটনার একানব্বই বছর পর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া স্মরণে আসে না ঘাটাল মহকুমার চেঁচুয়াহাটে ১৪ জন শহীদের আত্মবলিদানের কাহিনী। দেশ স্বাধীনের বয়সের মতো বেড়েছে স্থানীয় ইতিহাস বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। আর যতটুকু আছে রাজনীতির রঙে বিবর্ণ হচ্ছে দিনের পর দিন। আমাদের পূর্বসূরিদের দেশকে ভালোবেসে তাদের নিঃস্বার্থ দান বিস্মরণের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। ভুলে যেতে চাওয়া এই গর্বিত ইতিহাস শুধু দৈন্যতা নয়, মানসিক ক্লীবতা।