‘ভাই ফোঁটা’ —উমাশংকর নিয়োগী

‘ভাই ফোঁটা’ —উমাশংকর নিয়োগী
•ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা বর্তমানে বাংলার একটি লোকউৎসবের নাম। আমাদের শাস্ত্র মতে এটি যমদ্বিতীয়া । যম পুজোর দিন । মৃত্যুর দেবতা যমের গায়ের রঙ সবুজ, হাতে যমদণ্ড- গদা । লাল কাপড় পরে থাকেন ,এঁর বাহন মহিষ। ইদানিং কোথাও কোথাও যম পুজো করে গণ ভাইফোঁটা দেবার প্রচলন হয়েছে। আবার কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া যম- যমুনা- চিত্রগুপ্ত –যমদূত পুজো নামেও পরিচত। এ সম্পর্কে সামান্য কিছু জেনে নেওয়া যেতে পারে।
যম নামটি আমাদের ঋগ্বেদে পঞ্চাশ বারের মত উল্লেখিত হয়েছে। এই বেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তে যম যমীর কাহিনি আছে। সূর্য ও সংজ্ঞার পুত্র যম। যম দক্ষিণ দিকপাল। এই জন্য যমের দক্ষিণ দুয়ার বলা হয়। যমের পালিকা মাতা ছায়া । যম তাকে এক সময়ে লাথি মারেন । এর জন্য ছায়া তাকে অভিশাপ দেয়। যমের পায়ে ঘা হয়। পিতা সূর্যের নির্দেশে যমের কুকুর দিয়ে ঘা চাটিয়ে ঘা ভালো হলেও পা দুটি খুব সরু হয়ে গিয়েছিল। ভালোমত চলা ফেরা করতে পারতেন না । পিতার কাছে নিজের দুর্দশার কথা জানালে সূর্য তাঁকে উপায় বাতলে দেন। পিতার কথা মত স্থলে জলে জঙ্গলে ঘোরার জন্য মহিষকে বাহন করে যম চলা ফেরা করতে আরম্ভ করেন । যমের বোন যমী। যম স্বর্গের দেবতা বটে তবে অমর ছিল না । স্বর্গের দেবতা হলেও যম নরকের অধিশ্বর । যমের রাজধানীর নাম সংযমনী । যমের অনুচরের নাম মহাচন্দ ও কালপুরুষ । যম দক্ষপ্রজাপতির তেরটি মেয়ের পাণিগ্রহণ করেছিলেন। যুধিষ্ঠিরও এর এক পুত্র।
থাক ওসব কথা । পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় যমের বোন যমী যমের অমরত্ব কামনায় তার কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন আর সেই ফোঁটা নিয়ে যম অমর হয়ে যান। তাই ভায়ের দীর্ঘ আয়ু কামনা করে বোনেরা এই কার্তিক মাসের দ্বিতীয়াতে ফোঁটা দেয় । আর একটি কাহিনি আছে মথুরাপতি কৃষ্ণ নরকাসুর নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন কার্তিক মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশীতে । যা বাংলায় ভূতচতুর্দশী হিসেবে পালিত হয় তাই ভারতের অন্যত্র নরকচতুর্দশী । নকাসুরকে বধ করে তিন দিন পরে কৃষ্ণ রাজধানীতে ফিরলে বোন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন । প্রতিটি বোন চায় তার ভাই যেন কৃষ্ণের মত নরকাসুর রূপী অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে পারে । কৃষ্ণের মত শক্তিধর হয় এবং বোনের ভালোবাসার বিয়েতে কৃষ্ণের মত সহায়তা করে । ডুবেন্দু নয় , সব্যসাচীর (ডান হাত বাঁ হাতে সমান রোজগার করে যে, সব্যসাচী) মত স্বামী পেতে সাহায্য করে । কৃষ্ণ সুভদ্রার কাহিনি থেকে প্রভাবিত হয়ে বোনেরা ভাইদের ফোঁটা দিতে শুরু করে । সেই থেকে ভাই ফোঁটার প্রচলন হয়।
বাংলার ভাই বোনের মধুর সম্পর্কের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভ্রাতৃদ্বিতীয়া । উত্তর ভারতের রাখি বন্ধনের মত আমাদের ভাই ফোঁটা । যত আমরা তথাকথিত আধুনিক ও অর্থ সর্বস্ব হয়ে উঠছি, মৃত পিতার সম্পত্তি নিয়ে ভাই বোনের সম্পর্কে ফাটল ধরছে। ভাই ফোঁটা অনেক ক্ষেত্রে কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আমাদের নিঊ ক্লিয়ার ফ্যামিলির কল্যাণে বাড়িতে এখন একটি ছেলে বা মেয়ে। ভবিষ্যতে ভাইফোঁটা পাঁজির পাতাতেই লেখা থাকবে। ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় বোন প্রদীপ , ধূপ জ্বেলে ভাইয়ের কপালে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে করে চন্দন কোথাও কোথাও দইয়ের ফোঁটা দেয় । ফোঁটা দেবার সময় বাঙালি বোনেরা সাধারণত এই ছড়াটি বলে থাকে – ‘ ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা , আমি দেই ভাইকে ফোঁটা , যম যেমন চিরজীবী আমার ভাই যেন হয় চিরজীবী। ’ যমী বাংলায় যমুনা হয়ে গিয়েছে । শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ফোঁটা দেবার মন্ত্র – ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভম । অতঃপরং যমদ্বারে ময়াদত্তং হি কণ্টকম ।। এরপর শাস্ত্রের নির্দেশ ‘আচারাৎ ভ্রাতা চ ভগিনী হস্তাদ যত্নেন ভোক্তব্যঞ্চ।’ তা না হয় যত্ন করেই দিদি বা বোন ভাইকে খেতে দিল , তবে খেতে দেবার সময় বলতে হবে – ‘ ভ্রাতস্তবানুজাতাহং ( দিদি হলে বলতে হবে ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং ) ভুঙ্ক্ষ ভক্তমিদং শুভম । প্রীতয়ে যমরাজস্য যমুনায় বিশেষত।’ আর একটি দিক শাস্ত্র বলেছে , ‘ ভ্রাতা চ ভগিনীভ্যো বস্ত্রাদিকং দেয়ম।’ অর্থাৎ বোন কেবল ভাইকে বস্ত্রাদি দেবে না ভাইকেও বোনকে বস্ত্রাদি দিতে হয়।
এই যে প্রাপ্তি যোগ ও sখাওয়ার গন্ধ পেল বাঙালি আর রক্ষা আছে! বিয়ের জন্য ছেলে বা মেয়ে দেখতে , বিয়ের পাকা কথা বলতে , বিয়ে করছো খাওয়াও , পেটে বাচ্চা ? পঞ্চামৃত ? সাধ ভক্ষণ খাওয়াও । বাচ্চা জন্মেছে ? ষষ্ঠী পুজো ? আটকলাই ? অন্নপ্রাশন, পইতে ? খাওয়াও, মরবার আগে মরতে কত দেরী দেখে আঁচ করতে এসেছে প্রতিবেশী , প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে , শ্মশানে, শ্রাদ্ধে সর্বত্র খাওয়াও খাওয়াও রব। আর এতো ভাইফোঁটা ! এতে ভোজন হবে না ? ফোঁটা দিয়ে দিদি বা বোন ভাইকে বলে, ‘ খাই খাই কর কেন এস বস আহারে/ খাওয়াবো আজব খাওয়া ভোজ কয় যাহারে ।’ ভাই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে – কী কী আছে রে এবারে ? দিদি বা বোন বলে – ‘ ডাল ভাত তরকারি ফল মূল শস্য / আমিষ ও নিরামিষ চর্ব্য ও চোষ্য -/ রুটি লুচি ভাজাভুজি টকঝাল মিষ্টি, / ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি। ’ চর্ব চূষ্য লেহ্য পেয় ( হালকা + কড়া = পেয় ) খেয়েও কোন কোন শ্যালকের তৃপ্তি হয় না । তখন তার জামাইবাবু মনে মনে বউয়ের ভয়ে বলে –‘ এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা / খাও তবে কচু পোড়া , খাও তবে ঘণ্টা ।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।