তৃপ্তি পাল কর্মকার : বড়সড় একটা খেলার মাঠ আছে। যুবা তরুণের অভাব নেই এলাকায়। কিন্তু তারা কাজের বাইরে মাঠে ঘাটে আড্ডা দেয়, মোবাইলে খুটখাট করে সময় কাটিয়ে দেয়। আর আছে গালগল্প, পরচর্চা। যুবা-তরুণের নেই যেটা, সেটা হল খেলার মাঠে নামার উদ্যম। এই দৃশ্যগুলি মেনে নিতে পারেননি চন্দ্রকোণা-১ ব্লকের মহাবালা ওজিয়া হাইমাদ্রাসার শিক্ষক শেখ নজরুল ইসলাম। তাই তিনি এলাকার যুবকদের মাঠে নামানোর জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন চাকরি জীবনের অবসরের প্রাক্কালে।
নজরুলবাবুর বাড়ি দাসপুর-১ ব্লকের বৈদ্যপুর গ্রামে। তাঁর বাড়ি থেকে দুশো মিটার দূরে দাসপুর-২ ব্লকের দুবরাজপুরে বল খেলার একটি মাঠ রয়েছে। বেলিয়াঘাটা-কামালপুর রাস্তার পাশেই ওই খেলার মাঠটি রয়েছে বলে আশেপাশের গ্রামের প্রচুর যুবক-তরুণ- কিশোর বিকেলে আড্ডাও দেয়। আর এই আড্ডাটি মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না ‘নজরুল মাস্টারের’। শারীর শিক্ষার শিক্ষক তিনি। বয়স ষাটের কোটায় হলেও এই বয়সেও নিরোগ, নির্মেদ। যাঁর আজও ভোরবেলা উঠে মাইল খানেক দৌড়াতে অভ্যেস তাঁর পক্ষে এই খেলা বিমুখতা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব কি? তাই তিনি খেলার মাঠের যুবা তরুণদের এই আড্ডা তুলে দিয়ে মাঠ-মুখী করতে শুরু করলেন। ফিরিয়ে আনলেন দুবরাজপুর বলগ্রাউণ্ডে খেলার রেওয়াজ। নিজেই রেফারির ভূমিকায় নেমে চার পাঁচ খানা গ্রামের যুবকদের নিয়মিত ফুটবল খেলাচ্ছেন তিনি। দুবরাজপুর বল গ্রাউন্ডে আবার জোর কদমে খেলাধুলার চর্চা ফিরে এসেছে বলে এলাকার মানুষজনও খুব খুশি।
এখন নিয়মিত কমপক্ষে ৩০ জন খেলে। দুবরাজপুর, বৈদ্যপুর,ইসবপুর,গোপালপুর ভরতপুরের ছেলেরা ‘নজরুল মাস্টারের’ কারণে আজ শুরু করেছে খেলাধুলার চর্চা।
নজরুলবাবু দুবরাজপুর মাঠে খেলাধুলার চর্চা শুরু করেছেন মাস চারেক হল। আগেও করাতেন তবে অনিয়মিত। এবার আর অনিয়মিত নয় বরং জোরকদমে চলছে খেলাধুলা। আশেপাশের গ্রাম ক’খানি থেকে খেলতে আসে নাসিম সাহিন,মার্শাল হাঁসদা,আনিস রহমান, সৌমেন ঘোড়ইদের মতো দুরন্ত কিশোর-তরুণরা। দুঃস্থ অভাবী ঘরের ছেলেরাও খেলতে আসে। নজরুলবাবু মনে করেন, খেলার মাঠ অনেক কিছু শেখায়। সখ্যতা শেখায়, ভাব বিনিময় শেখায়, মানবিকতা শেখায়। তাই খেলার মাঠে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বও খুব খাঁটি হয়।
পরিস্থিতি অনুকূল হলে, সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে ন্যূনতম সহযোগিতা করলে আগামী দিনে দুবরাজপুর মাঠে নানা রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করারও স্বপ্ন রয়েছে নজরুলবাবুর। তিনি বলেন, যুবকদের নিয়ে মাঠে খেলানো আমার একার পক্ষে সম্ভব হলেও বড় কিছু চালিয়ে যেতে হলে অনেককেই পাশে চাই। তাই সবাই হাত বাড়িয়ে দিলে জার্সি পরা যুবকদের নিয়ে এই মাঠটাকেও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারব।
শুধু কী খেলা? খেলার মাঠ খেলার বাইরে অনেক কিছু শেখায় পড়ায়। তাই মানবিকতার লেনদেনও হয় এখানে। দুবরাজপুর হাটের এক দোকানদার উত্তম ঘোড়ই বলেন, অনেক দুঃস্থ ছেলেকে ‘নজরুল মাস্টার’ ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেছেন। কাউকে বই কিনে দিয়েছেন, কাউকে অন্যভাবে সাহায্য করেছেন, যার যেমন সমস্যা, যতটা পারা যায় পাশে দাঁড়িয়েছেন। নজরুলবাবু বলেন, তবে সবকিছু ওই খেলার জন্যই। খেলতে আসা ছেলেগুলোর সঙ্গে মিশতে পেরেছেন বলেই তো জানা সম্ভব হয়েছে কার কী সমস্যা!
স্কুলেও এখনও শরীরচর্চার ক্লাস করান নজরুলবাবু। এই সামনেই রিটায়ার্ড। মাস তিনেক বাকি। কর্মজীবনে শীঘ্রই আসতে চলেছে বিরতি। তবে কর্মহীন থাকতে চান না তিনি। মন চায় না কর্মবিরতি। খেলা ভালোবাসেন বলে খেলার মধ্য দিয়েই আবার ব্যস্ত হয়ে, নতুন করে শুরু করতে চান। তাই ছেলেদের খেলার চর্চাকে ইন্ধন দেন। দুবরাজপুর বলগ্রাউণ্ডে খেলাধুলার রেওয়াজ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আজকের দিনে সমাজকে তথা ইয়ং জেনারেশনকে কী বার্তা দিতে চান নজরুল স্যার? নজরুল ইসলাম বললেন, এই যুব প্রজন্মের ওপরে আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। আজকাল দেখি তারা পরিশ্রম বিমুখ, আর মোবাইলে অকারণে ব্যস্ত। এই প্রজন্ম কর্মবিমুখ হলে আখেরে আমাদের সবার ক্ষতি। ক্ষতি দেশেরও। তাই ওদের ভালো কাজে উসকে দিতে হবে। খেলাধুলার প্রতি একবার উসকে দিতে পারলেই কিশোর তরুণের দল প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে দেশ ও দশের সম্পদ। সমাজের অস্থিরতাও কমে যাবে। সুষ্ঠুভাবে এগোবে সব কিছু।
আর সবার জন্য বললেন, সব বয়সের মানুষের উচিত আজীবন ফিট থাকা তার জন্য শরীর চর্চা অবশ্যই মাস্ট। •ছবিটি নজরুল ইসলামের।
Home এই মুহূর্তে খেলা-ধুলা স্মার্টফোন বাদ দিয়ে যুবকদের মাঠ-মুখী করার ব্রত নিয়ে নিয়মিত লড়ে চলেছেন...