পাপিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল: আজও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেকোনও কৃতকর্মের জন্য মহিলাদেরকেই দায়ী করে। সম্প্রতি ঘাটালে ঘটে যাওয়া এই পরকীয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর জন্য দোষারোপ করা হয় শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই। শাস্তিও সেইমতো মহিলাদেরই প্রাপ্য হয়। আমি একজন মহিলা হিসেবে এর তীব্র নিন্দা করছি! অবশ্যই আমি পরকীয়াকে সমর্থন করছি না। কিন্তু যদি দোষ দেওয়ার প্রসঙ্গই আসে তাহলে শুধু মহিলা কেন সেই পুরুষ সঙ্গীটিকেও একই অপরাধে অপরাধী করা হোক।
কোনও সম্পর্ক একপাক্ষিক হয় না। তাই এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি নিশ্চয়ই। এখন প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ে পরকীয়ার শাস্তি হিসেবে মেয়েটিকে এই করা হলো, ওই করা হলো। মেয়েটির নামসহ তার গুষ্টির ঠিকানা খবরের শিরোনামে উঠে আসে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ছেলেদের দিকে কখনোই আঙুল দেখানও হয়নি। কারণটা কী! এরপর দিকে দিকে মেয়েটির নামে যখন সমালোচনার ঝড় ওঠে তখন মেয়েটি যদি আত্মঘাতী হয় তার দায় কে নেবে? আধুনিক সমাজের সমস্ত সুবিধা নিয়েও কি আমরা সেই ঠাকুমাদের মুখের সেই কথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি? যেটা ছেলেদের উদ্দেশে ওনারা প্রায়ই বলতেন ‘সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা’।
প্রথমত, যাদের মধ্যে সম্পর্ক হয় তারা উভয়েই সাবালক। তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক গড়ে উঠবে সেটা তারাই ঠিক করবে। দ্বিতীয়ত, কেউ দুদিন খেতে না পেলে কেউ খাওয়াতে আসবে না অথচ দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ কখন তাদের বাড়িতে অন্তরঙ্গ হচ্ছে সেদিকে কড়া দৃষ্টি রেখে, অসভ্যের মত দরজায় শিকল দিয়ে দাগিয়ে দেয়– ধরা পড়েছে! কিরকম হাস্যকর ব্যাপার না! সব থেকে বড় কথা এই ধরা পড়ার পর মেয়েটির সাথে সমাজ ও পরিবার এত নোংরা আচরণ করে, মেয়েটি সুস্থভাবে বাঁচা তো দূরে থাক নিজে আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিতে বাধ্য হয়। অথচ ছেলেটির গায়ে এর ন্যূনতম আঁচটুকু লাগে না, সে দিব্যি অন্য মহিলাকে বিয়ে করে নিশ্চিন্তে সংসার করে। বিচার এমন কেন! যদি অপরাধের কথাই আসে তাহলে কি শুধু মেয়েটিরই অপরাধ ছিল?
এরপর যে সমাজ মেয়েটিকে নষ্টা বলে দুষলো, সে সমাজ (মূলত পাড়া) ওই মেয়েটির জন্য কী করেছে? কোনদিন কি মেয়েটির কাছে জানতে চেয়েছে আজ যে মেয়েকে নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা সে কেমন আছে? করেনি, করে না। সবথেকে দুঃখের কথা ওই মেয়েটাকে নষ্টা বলা লোকজনদের মধ্যে মহিলাদেরও সক্রিয় সমর্থন আছে।
আর গত ২৭ জুন শুক্রবার ঘাটালের প্রতাপপুরের ওই পরকীয়ার খবরটাই যদি দেখি, একবারও ছেলেটির নাম উঠে আসেনি। আর মেয়েটির ছবিসহ তার জীবনবৃত্তান্ত দেওয়া হয়েছে। আবার শাস্তি কারা দিয়েছে? গণ আদালত। সে আবার কি! খায় না মাথায় দেয়!সেই জুলিয়াস সিজারের সময় বলা হয়েছে এই ‘গণ’ কথাটি ‘মব’ কথাটি থেকে এসেছ। মানে বিশৃঙ্খলতা। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই ‘গন’ কে সিদ্ধান্তনিতে দিলে এটাই হবে। তাছাড়া দেশে কি সংবিধান নেই? নাকি বিচারব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। যারা ওই মেয়েটিকে আজ এরকম শাস্তি দিয়েছে তারা কোনওদিন কি জানতে চেয়েছে যে ওই মহিলা কেন এরকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো?
মহিলারা আজও অবহেলিত। কেউ শারীরিক দিক থেকে আবার কেউ মানসিক দিক থেকে। তারা বাড়ির পুরুষদের দ্বারা বঞ্চিত। তার মনের খোঁজ পরিবারের কেউ কি রাখে?
আজও কোন মহিলা রেপ্ট হলে তার পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে সবাই তাকে মানসিক সমর্থন জানানোর বদলে তার সাথে এমন আচরণ করে যেন মেয়েটির সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে, এই সমাজে সে বাঁচবার অযোগ্য। অথচ যে ছেলেটি বা ছেলেগুলি এই নোংরা কাজ করলো তারা কিন্তু সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি অবিচার মেয়েটির সঙ্গে করা হলো একবার ভাবুন! যেখানে এই পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে, ওই ছেলেটির বিরুদ্ধে মেয়েটির গর্জে ওঠা দরকার, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা দরকার, তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে না দিয়ে নতুনভাবে বাঁচবার জন্য উৎসিত করা প্রয়োজন, তাকে আরো বেশি করে বোঝানো প্রয়োজন, তার কিছু ক্ষতি হয়নি, এখানে তার কোন দোষ ছিল না। সেখানে উল্টে মেয়েটিকে ক্রমাগত মানসিক অত্যাচার করে তাকে এমন অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় যখন সে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
এরপর তো রয়েছেই বিয়ের পর বাচ্চা না হলে প্রথমেই দোষ গিয়ে পড়ে মেয়েটির ওপর। অথচ কম বেশি সবাই জানেন যে বাচ্চা হবার ক্ষেত্রে মেয়ের একার হাত থাকে না। অথচ ছেলের সমস্যা থাকলেও তার দিকে কেউ আঙুল তোলে না। আজও চোখে পড়ে কন্যা সন্তান হওয়ার পর শ্বশুর বাড়ির তরফে মেয়েটির জন্য অপমান জোটে, কি আশ্চর্য যেখানে মেয়েটির সেখানে কোন ভূমিকাই নেই! এরপর সমাজে প্রচলিত যত গালাগাল শুনি সবই মহিলাদেরই শুধু ইঙ্গিত করে।
না আর বলবো না। এরপরও কিছু বলার থাকে? আমি জানি অনেক মহিলাই আমার মতো ভাবেন, শুধু আমরা মহিলারা একটু চোখ, কান খোলা রাখলে দেখতেও পারি বুঝতেও পারি যে এইসমস্ত অপমানগুলো মেনে নিয়ে আমরা আজও ওই পুরুষদের ভুল চিন্তাগুলোকেই পুষ্ট করছি, কেউ সক্রিয় ভাবে কেউ বা নিষ্ক্রিয় ভাবে। একবার ভেবে দেখি তো আমরাই অপয়া, আমরা নষ্টা, আমরাই বন্ধ্যা আবার আমরাই নাকি দুশ্চরিত্রা। আবার আদিখ্যেতা করে সেই মহিলা শক্তিকে দুর্গা, কালির রমরমিয়ে, গদগদ ভক্তি নিয়ে পুজোও করে সমাজ। সবকিছুই যেন কিরকম গোলমেলে না! সমস্তটাই চক্রান্ত করে যুগ যুগ ধরে মহিলা শক্তিকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা আজও প্রবহমান। এবার সমস্ত নারী শক্তি জাগো, অনেক হয়েছে। কিসে কম যাই আমরা? তাই আমি একজন মহিলা হয়ে সমস্ত মহিলাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ আপনারা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হোন। একমাত্র মহিলারাই পারে মহিলাদেরকে অপমানিত হবার হাত থেকে বাঁচাতে। তাই সবাই একজোট হোন, কোন নীতি বিরুদ্ধ কাজ করলে অবশ্যই আইনের কাছে শাস্তি পাবে। কিন্তু একই দোষ করে পুরুষরা এই দোষের ভাগীদার হবে না কেন? পরিশেষে বলি আমাদের সভ্য দেশে, সভ্য সমাজে দুজন প্রাপ্ত বয়সের নারী-পুরুষের সম্পর্ক হলে তাদের মধ্যে নাক গলানোর নৈতিক অধিকার কারোর থাকতে পারে না।