তৃপ্তি পাল কর্মকার [সম্পাদক, স্থানীয় সংবাদ]: কোভিড পরিস্থিতিতে অনেক ছাত্রছাত্রী অবসাদের শিকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে সেই সব ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাটাও হোক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।
দু বছর ধরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব পড়েছে ছোটো থেকে বড় সব ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই। অনেকে আছে যাদের কাছে পাশ করাটাই বড় বিষয় ছিল। এই কোভিড পরিস্থিতি তাদের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল। গর্দান পাশ এবং দেদার ঢালাও নাম্বারের দৌলতে তারা টপ করে দুটো ক্লাস পার হয়ে গেল। আবার এই গর্দান পাশের রীতি রেওয়াজ অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের পীড়ার কারণ হয়েছে। যারা সত্যিকারের প্রতিযোগী মনোভাব লালন পালন করে, করোনা তাদের অনেককিছু কেড়ে নিল। প্রতিযোগিতার যে গতি এবং মানসিকতা নিয়ে তারা এগোচ্ছিল তার মধ্যে কেউ যেন মাঝপথে কংক্রিটের দেওয়াল তুলে দিল। আর যেটা হল অবাধ নাম্বার আর গর্দান পাশের ফলে মুড়িমুড়কি আর সন্দেশ এক দামেই বিকোল। একটা মেধাবী ছাত্র যে নাম্বার পেলো একজন সাধারণ ছাত্রের নাম্বারও এক। এক্ষেত্রে দুই ছাত্রের দু’রকম মানসিক পরিবর্তন দেখা গেল। সাধারণ ছাত্রটি ফুরফুরে মেজাজে চলাফেরা করতে শুরু করল, আর মেধাবী ছাত্রটি অবসাদে মুষড়ে পড়ল। আর এই অবসাদ এক ছাত্র বা ছাত্রীর মনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন নিয়ে এল।
এই এতো নাম্বার বা এই গর্দান পাশ সব কিছুই যে পরিস্থিতির জন্য এটা মেধাবী মন কিছুতেই মানতে রাজি নয়। যে গতিতে যে স্বপ্ন নিয়ে তারা এগোচ্ছিল হঠাৎ সেই গতিতে খেই হারানো বা পূর্ণচ্ছেদের মতো ব্যাপারটা মানতেই পারেনি। তাই অবসাদ এসেছে মনের সবটা জুড়ে। তার ওপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের সান্নিধ্যে যে সহজ স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল সেটা থেকেও বঞ্চিত তারা। বদলে দু’বছর ধরে একটা ভার্চুয়াল পরিবেশ এল, যাতে ছাত্রছাত্রীরা পেলো একাকীত্ব ও সাথীহারা জীবনযাত্রার পরিবেশ। হাতে উঠে এল মোবাইল। গৃহবন্দিদশায় একমাত্র বন্ধু হল মোবাইল। একাকীত্ব কাটাতে সব সময় ফোনে খুটুর খাটুর। গেম খেলে বা ভিডিও দেখে কাটতে লাগল বান্ধবহীন বন্দিদশা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে এই বন্দিদশার তুলনা কোনওভাবেই চলে না। হতাশা এবং সময় কাটাতে অনেকেই বেছে নিয়েছে মোবাইল গেম। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটছে মোবাইল হাতে নিয়ে বা কম্পিউটার টেবিলে। এইপর্যায়ে দিনের পর দিন কাটাতে কাটাতে অভ্যস্থ একটি ছেলে বা মেয়ে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেকটাই কম্পিউটার চালিত বা মোবাইল চালিত হবার প্রভাব বা ঘোর কাজ করে স্নান খাওয়ার সময়েও। উদাহরণ স্বরূপ এক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রের মা খাবার টেবিলে দেখলেন ছেলের মুখ থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোচ্ছে। ভয়ে সিঁটিয়ে তিনি মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন ওই শব্দগুলি নাকি একটি গেমে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কি করতে পারেন ওই ছাত্রের বাবা মা? তারা খাইয়ে দাইয়ে ভালো রাখতে পারেন, রোগ জ্বালা হলে সেবা করতে পারেন, কিন্তু কোনওভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ঘরের মধ্যে দিতে পারেন কি? যতই বলা হোক বাবা মা বন্ধুর মতো, কিন্তু সেভাবে মিশলেও বাবা মা আর সহপাঠীদের তফাৎ একটা থাকেই। এভাবে করোনার ঢেউ গুনে গুনে দিন কাটাতে কাটাতে বাবা মায়েরাও অবসাদের শিকার। তাদের অবসাদ কিভাবে ভালো থাকবে তাদের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সে চিন্তা করে করে। অনেক ছেলে মেয়েকে বাবামায়েরা মনোবিদের কাছেও নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসে আবার সেই বন্দিদশা, সেই এক রুটিন একটুও বিষন্নতা কমাতে পারেনি।
ছোটো বড়ো সব শিক্ষার্থীর বাবা মায়েরা চান অনেক হয়েছে, আর না। এবার খুলে দেওয়া হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজ পর্যন্ত কোভিডের তিনটে ঢেউ গুনে ফেললাম আমরা। ভবিষতে আরও ঢেউ আসবে। যেহেতু ক্রমাগত মিউটেশন হচ্ছে ভাইরাসের, তাই এই রোগ থেকেই যাবে। পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র সব জায়গাতেই বছরের কোনও না কোনও সময় উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে এই ভাইরাসের। তার মধ্যেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে।
এই দু বছরে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক ক্ষতি হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের। আর নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক সব শিক্ষার্থীর জন্য। আর এই কোভিড অবসাদের শিকার যে সব ছাত্র-ছাত্রী তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাটাও করা হোক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।
Home এই মুহূর্তে শিক্ষা/সাহিত্য/সংস্কৃতি কোভিড পরিস্থিতিতে অবসাদের শিকার শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক