‘জাড়া রাজবাড়ির ইতিহাস’ —অর্জুন পাল[WBCS, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ঘাটাল মহকুমা]
•ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যেন কথা বলে বঙ্গের বিভিন্ন ঠাকুরদালানে। এই ঠাকুরদালানগুলো [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]আর বনেদিবাড়ি ঘুরে দেখলে বোঝা যায়, কোনো কোনো ঠাকুরদালানের বয়স ৩০০ বছরের কাছাকাছি, কোনো কোনোটা ৩০০ বছরেরও বেশি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সিনেমা তো সবার দেখা। এই সিনেমার কবিগানের দৃশ্যে আমরা এক রাজবাড়ির মন্দিরকোঠা দেখেছিলাম। সেই মন্দির প্রাঙ্গণ আজও দেখা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের জাড়াগ্রামে। সিনেমার চরিত্র হিসেবে ভোলা কবিয়ালকে নিশ্চয় মনে আছে। এই ভোলা কবিয়াল চরিত্র টি তৈরি হয়েছিল ভোলা ময়রা কে কেন্দ্র করে।
তৎকালে জাড়া রাজবাড়ির সুনাম ছিল সর্বজনবিদিত। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়,বর্ধমানের জনৈক ব্রাহ্মণ জমিদার একবার জাড়া গ্রামে আসেন। জমিদারী রক্ষার কাজ নিয়ে। ক্রমে রাজস্ব আদায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই গ্রাম আয়বর্ধক হয়ে ওঠে। পাকাপাকিভাবে তিনি মেদিনীপুরেই থেকে যাওয়ার কথা ভাবেন। কুলদেবতা গোপাল ঠাকুরের মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। গাঙ্গুলী পদবী ছিল এই ব্রাহ্মণ বংশজাত জমিদারের। পরবর্তীতে নিজের কাজের দ্বারা রায়বাহাদুর উপাধি পান তিনি। এরপর নিজেকে রামগোপাল রায় হিসেবেই পরিচয় দিতে থাকেন। তিনিই প্রথম কালীপুজো প্রবর্তন করেন। ১১৫৫ বঙ্গাব্দে স্বহস্তে দুর্গামন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে পলাশীর যুদ্ধের ও আগের প্রতিষ্টিত হয়েছিল এই জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়িতে আজও রীতি নীতি মেনেই হয় দূর্গাপুজো।
এই বংশের সুসন্তান রামগোপাল রায়ের সুপুত্র রাজীবলোচন রায় জাড়া বংশের গৌরবকে আরও মহিমান্বিত করেন। শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান রাজীবলোচন রায়ের সে সময়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা। এই রাজীবলোচন রায় পরবর্তীকালে ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন এবং তাঁর হাত ধরেই দুর্গাপুজোর সূচনা হয় জাড়া রাজবাড়িতে।
জাড়া রাজবাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। সেই প্রথম দিন থেকে আজও রায় পরিবারে প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই পুজো হয় দেবীর। এই রাজবাড়ির পুজো হয় বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে এবং এখানে বলিদানের কোনো প্রথা নেই। মহাষ্টমীর দিন ব্রাহ্মণভোজন এবং দরিদ্রনারায়ণ সেবার আয়োজন করেন রাজবাড়ির সদস্যরা। এই বাড়িতে পুজোর সময় প্রায় পঁচিশ রকমের রান্নার পদ হয় – খিচুড়ি, সাদাভাত, নানা রকমের ভাজা, তরকারি, পায়েস, চাটনি ইত্যাদি। মহানবমীর দিন পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে মিলে খাওয়াদাওয়া করেন। পুজোর সময় রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বিশিষ্ট মানুষজন আসতেন রাজবাড়িতে। সন্ধিপুজোর সিঁদুরখেলায় এখনো আসে অগণিত দর্শনার্থী। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর রাজবাড়ির ছাপান্ন কর্তার পরিবার একত্রে নজরুলগীতি গাইতে গাইতে ঘরে ফেরেন। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর পরিবারের সকল সদস্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘যাসনে মা ফিরে, যাসনে জননী’ গানটি গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন। সে যেন এক বিষাদময় পরিবেশ। বাড়ির মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়েছে, আবার একটা বছরের অপেক্ষা। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো শেষ হলে শুরু হয় কালীপুজোর প্রস্তুতি।
রাজবাড়ির ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যে জেগে আছে ইতিহাস। তাতে মিশে বিষ্ণুপুরী ঘরানা ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের মিশেল। ফাটল ধরা, আধভাঙা, শ্যাওলা পড়া দালানকোঠা তার। পিছন দিকে এক বিশাল জলাশয়। কিন্তু আজ সবই বিবর্ণ , জীর্ণ – রাজবাড়ী যেন এক মহামারী রোগে অসুস্থ। দেখলে কে বলবে এককালে রাজমহিষীর পায়েলের শব্দে মুখরিত থাকতো সেই প্রাসাদ ? কোঠাবাড়ির প্রতিটি ইট, আজও করে চলেছে বাবুয়ানির হিসেব- রাজবংশের প্রাচীনত্ব। তিনশো বছর ধরে তার বুকে জমে উঠেছে কতই না ঐতিহাসিক স্মৃতি ।