দুর্গাপদ ঘাঁটি: রাতারাতি প্রায় কুড়ি বিঘা এলাকা ঘিরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত পাঁশকুড়া থানার চকগোপাল গ্রামে গজিয়ে উঠল এক তীর্থক্ষেত্র। কীভাবে গজিয়ে উঠল সে ব্যাপারে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনের মধ্যে তেমন কৌতুহল নেই। বিশ্বাসে জোয়ার এনে পুণ্যার্জনের জন্য ভিড় করছেন সেই মন্দির চত্বরে।
এই মন্দির সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি হল- সালাজপুর, গোপাল হাজরা, বিগড়া, বলরামপুর, চকবোয়ালিয়া, রাধাবল্লভপুর, জ্যোতিসব, ধর্মা, পাইকান বোয়ালিয়া, চকসুন্দর, বিহারীচক। এই গ্রামগুলিতে প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর তপশিলীভুক্ত মানুষের বসবাস। অভাব, দারিদ্র্যতা, বঞ্চনা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস তাঁদের নিত্যসঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে এখনও। সুস্থ সংস্কৃতির ছিটেফোঁটা তাঁদের চেতনায় উঁকি মারেনি। এতগুলি গ্রামের প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের শিক্ষা নেওয়ার জন্য কোন উচ্চ-বিদ্যালয় নেই। প্রায় ১২টি গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য পাঁচ-সাত কিমি যেতে হয় পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে। ফলে বেশির ভাগ ছেলে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাটুকু নিয়ে শিক্ষার ইতি টানতে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় চুয়াত্তর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বার বার রাজনৈতিক পালা বদল ঘটেছে। তাদের বদান্যতায় যেটুকু উন্নতি হয়েছে তা সাহারা মরুভূমির রুক্ষ-শুষ্ক বালুকারাশির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কয়েক বালতি জল মাত্র। এখনও বেশিরভাগ কাঁচা ভাঙা চোরা বাড়ি। মাঝে মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবাস যোজনার গুঁটি কয়েক খুদে খুদে কিছু বাড়ি। হয়তো কিছু কিছু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে তা বাইরের রাজ্যের স্বর্ণ শিল্পের হাত ধরে।
যাই হোক, পেটে খিদে থাকলেও আছে ধর্ম বিশ্বাস ও ভাবাবেগ। তার উপর ভর করে পুজোর খরচ চালানোর জন্য গরীব মানুষের সর্বস্বান্ত করতে ডাইস-লটারি ও মদের দোকান বসিয়ে গোপাল হাজরা, রাধাবল্লভপুর সহ আরও কয়েকটি গ্রামে বেশ বড়সড় কালী, শীতলা, ভীম পুজোর সঙ্গে শয়ে শয়ে পাঁঠাবলি দিয়ে ধুমধামের সঙ্গে হয়। কিন্তু এত করেও তাঁদের সেই অভাব, যন্ত্রণা, অশিক্ষা এখনও কালো রাত্রির মতোই রয়ে গিয়েছে। এমত ধর্মাচরণে খুশি নয় জনাকয়েক বাসিন্দা। তাই বীরভূমের তারাপীঠকে টেক্কা দিতে চকগোপাল গ্রামে বৃহদাকারে স্বর্ণরৌপ্য খচিত মূর্তি সহ কালী ও বামাক্ষ্যাপার মন্দির নির্মাণ ও উদ্বোধন হয়েছে তাঁদের হাত ধরে।
চকগোপাল গ্রামের প্রভঞ্জন দোলই ও সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী রুজি রোজগারের তাগিদে মুম্বাইতে স্বর্ণশিল্পের কাজে গিয়েছিলেন। গত দশ পনের বছর স্বর্ণশিল্পে মন্দার কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে তাঁদের সংসার । কিন্তু এই দুই ব্যক্তির রোজগারের পালে আসে হঠাৎ দখিনা হাওয়া। শিল্পীদ্বয় যে শেঠের কাছে কাজ করতেন পথদুর্ঘটনায় হঠাৎ সপরিবারে মৃত্যু হওয়ায় তাঁর সঞ্চিত বহুকোটি টাকার সোনা ও আরও বহু সম্পদ রাতের অন্ধকারে উক্ত দুই ব্যক্তির হাতে চলে আসে। হঠাৎ তাঁদের হাতে এত অবৈধভাবে আশাতীত সম্পদ আসায় কি করবেন ভাবতে থাকেন। হঠাৎ মনে আসে এমন ভাবনা। তাই রাতারাতি গড়ে তুললেন এমন তীর্থক্ষেত্র। কোভিড-১৯ এর নিষেধাজ্ঞায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকলেও লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমে মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ ও পুলিশ- আমলা এবং বিখ্যাত ফিল্মস্টারদের উপস্থিতিতে মন্দিরটি উদ্বোধন হয় মহা সমারোহে।
এখবর পেয়ে দূর দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থী কাতারে কাতারে আসতে থাকেন মন্দির দর্শন ও পুণ্যার্জনের জন্য। এখন শোনা যায় প্রতিদিন প্রচুর টাকা করে দক্ষিণা হয় যা জমা পড়ে নির্মাতাদের হাতে। জেলার বেশ কিছু শুভ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এপ্রসঙ্গে বলতে শোনা গেছে যে, সোনার উপর সরকারি কঠোর বিধি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ এত পরিমাণ সোনা কীভাবে বিক্রয় হল খোলা মার্কেটে এবং কীভাবে ইনকাম ট্যাক্সকে ফাঁকি দিয়ে ব্যাঙ্ক ডিলিং করলেন ঐ অল্প রোজগারী দুই ব্যক্তি। কীভাবে কোনও তদন্ত না করেই পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে তীর্থক্ষেত্রের উদ্বোধন হল। তাঁদের আরও প্রশ্ন— উক্ত গ্রামগুলিতে যেখানে এখনও জগদ্দল হয়ে থাকা দারিদ্রতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতা, নিরাপদ বাসস্থানের অপ্রতুলতা ও সুস্থ সংস্কৃতির চেতনার অভাব যা দূর করা খুবই জরুরি ছিল সেইগুলো কি এই মন্দির কোনওদিন পুরণ করতে পারবে?