দেবাশিস কর্মকার:যেকোনও নতুন সৃষ্টির পেছনে থাকে মূলত একটিই তাড়না। সেটি হল প্রয়োজন। প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ যুগে যুগে সৃষ্টিযজ্ঞে মেতে উঠেছে। কখনও সফল হয়েছে, কখনও বিফল। কিন্তু চেষ্টার নিরন্তর ধারা আজও প্রবাহমান রয়েছে একইভাবে। একটি সত্যি কথা হল, পৃথিবীর বুকে যত সৃষ্টি হয়েছে, সাধারণ মানুষ অধিকাংশ সৃষ্টিকর্তাকেই ভুলে গিয়েছে। বা তাঁর খোঁজখবর রাখার চেষ্টাও বিশেষ করেনি কেউ। তাঁরা বেঁচে থাকেন কাজের মধ্যেই। তবুও যাঁদের প্রচেষ্টায় পৃথিবীর বুকে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তাঁদের কর্মযজ্ঞকে স্মরণ করাটার মধ্যে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ আছে।
পাশাপাশি সামনের প্রজন্মের কাছে সেই ইতিহাসটা হয়ত একটা অনুপ্রেরণারও কারণ হতে পারে। আর এই কারণেই আজকের এই নিবন্ধের অবতারণা।
মেহেদী হাসান। এই নামটা শুনলে অধিকাংশই প্রথমে মাথা চুলকোবেন। কারণ নামটি বিশেষ পরিচিত নয় আম জনতার কাছে। এমনকী নেট দুনিয়াতেও খুব কম লোকেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু আজ যেকোনও ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলায় লেখালিখির রেওয়াজ যে ঝড়ের গতি ছাড়িয়েছে তার সিংহভাগ অবদান কিন্তু এই মানুষটির। বাংলা টাইপিং-এর ইতিহাসে এই মানুষটির অবদান তাই অনস্বীকার্য।
আসুন বিষয়টি একটু বিস্তৃত আলোচনা যাক-
আজ থেকে দু দশক আগে ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লেখালেখির চর্চার চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তখন বাজারে মোটামুটি দু একটিই জনপ্রিয়ও বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার ছিল। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল-বিজয় সফটওয়্যার। কিন্তু এই সফটওয়্যারে কাজ করা আজকের এই সহজ সাবলীল টাইপিংয়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে আকাশ-পাতাল তফাত। তখন আলাদা বাংলা কি-বোর্ড পাওয়া যেত, অক্ষর টাইপ করতে হত খুঁজে খুঁজে এবং যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে নানা জটিলতার মধ্যে পড়তে হত টাইপ রাইটারদের। তাই একটা লেখা লিখতেই প্রচুর সময় ব্যয় হয়ে যেত। তাছাড়া সেই সময় নিজের মতো করে টাইপিং লে-আউট তৈরি করারও কোনও পদ্ধতি ছিল না। আর তার ফলে সফটওয়্যারে দেওয়া লে-আউটেই অভস্থ্য হতে হত টাইপিস্টদের।
উপরের এই সমস্যাগুলির সমাধান দিতেই মূলত অভ্র সফটওয়্যারের সৃষ্টি। বাংলাদেশের মেহেদী হাসানই হলেন এই ‘অভ্র’-র স্রষ্টা। যে অভ্র দিয়ে আমরা বেশিরভাগ বাঙালিই বাংলা টাইপ করি। মেহদী মাত্র ১৮ বছর বয়েসেই এই সফটওয়্যারের কাঠামো বানিয়ে ফেলেছিলেন। প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি আকর্ষণই তাকে এই কর্মযজ্ঞে ঠেলে দিয়েছিল। ২০০৩ সালে ওমিক্রন ল্যাব ওয়েবসাইট থেকে অভ্র প্রথম প্রকাশ্যে আনেন মেহেদী। তারপর থেকে নানা টেকনিক্যাল সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এই সফটওয়্যার টিকে। প্রতি বছরই কিছু না কিছু আপগ্রেডেশন আনা হয়েছে সফটওয়্যারটিতে। অবশেষে ২০০৭ সালে সফটওয়্যারটির পোর্টেবল এডিশন বাজারে আনা হয়।
অভ্রর যে বৈশিষ্ট্যগুলি সকলের নজর কেড়েছে আসুন এক ঝলকে দেখে নেই-
অভ্রর প্রথম সুবিধার দিকটি হল, এটি ইউনিকোড সাপোর্ট করে। ফলে যেকোনও ফন্ট-এই লেখা হোক না কেন উনিকোড সাপোর্টেড যেকোনও ডিজিটাল মাধ্যমে তা পড়া যায়। অভ্রের আর একটি সুবিধা হল, এতে কি-প্যাড লে-আউট ইউজাররা নিজের মতো করে তৈরি করতে পারেন। সেইসঙ্গে অভ্রতে ইউনিকোড ব্যবহার করে, ফোনেটিক ল্যাঙ্গুয়েজে টাইপ করা যায়। অর্থাৎ আপনি বাংলায় যে বাক্য লিখতে চাইছেন, অভ্র চালু করে ইংরাজি হরফেই সেটা লিখলে সেটাই বাংলা হয়ে যায়। যেমন, আপনি ‘ঘাটাল’ লিখতে চাইলে, ‘ঘ’ এর জন্য ‘জিএইচ’ লিখলেই হবে। অন্যদিকে আগে নিদৃষ্ট বর্ণের জন্য নিদৃষ্ট লে-আউট মনে রাখতে হত টাইপিস্টদের। নিজের মতো করে লে-আউট তৈরি করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না।
এছাড়া এতে রয়েছে সঠিক বানানের একটি লিস্ট। যেখান থেকে ইউজাররা লেখালেখি করার সময় সঠিক বানানটি দেখে নিতে পারেন। অভ্র সফটওয়্যারটি যেকোনও ইউএসবি ড্রাইভে করে পোর্ট করে নিয়ে যেতে পারেন এবং সফটওয়্যারটির পোর্টেবল এডিশনের সাইজ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের থেকে অনেকটাই ছোট। সর্বোপরি সবটাই আপনি পাচ্ছেন বিনামূল্যে। অর্থাৎ সফটওয়্যারটি ইন্সটল বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনার কোনও সাবস্ক্রিপশন খরচ লাগছে না।
মেহদী অভ্রকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি কোনোদিনই। নিজের মাতৃভাষার জন্য যা করেছেন তার মূল্য ব্যবসায়িক লাভের নিরিখে বিচার করতে নারাজ তিনি। তাই তাঁর স্লোগান – ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’। ভাষা যে উন্মুক্ত হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। এখন আট থেকে আশি সকলেই খুব সহজে আয়ত্ত করে নিতে পারছেন বাংলা টাইপিং। যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু নেট জগতের কুশীলবরা আজ অভ্রের উপরই নির্ভরশীল। সত্যি বলতে এখন অভ্র ছাড়া বাংলা টাইপ আমরা আর ভাবতেই পারি না।
৩৩ বছর বয়েসি মেহেদী তাঁর এই কর্মের জন্য বিশেষ পুরস্কার পাননি। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য তিনি যা করেছেন তা অবশ্যই সকলের প্রশংসার দাবি রাখে। ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য নিজের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল বিনামূল্যে তুলে দিলেন আমজনতাকে। ভাষার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন এর চেয়ে বেশি আর কী হতে পারে?