ভীম দেবতা: পৌরাণিক, লৌকিক ও ঐতিহাসিক
—অরূপরতন মিশ্র
♦মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে বাংলা জুড়ে ভীমপুজোর রেওয়াজ আছে। বিশেষতঃ দক্ষিণবঙ্গের কৃষিপ্রধান এলাকাগুলোতে ভীম দেবতার বিশালাকায় মূর্তি গড়ে ঘটা করে পুজো হয়। পাণ্ডবভ্রাতাদের মধ্যে ভীম কিভাবে এতো জনপ্রিয় দেবতা হয়ে উঠলেন তার সুলুক সন্ধান করলে তিনটি রূপে ভীমকে পাওয়া যায়—–পৌরাণিক তথা মহাভারতের ভীম, লৌকিক ভীম তথা ক্ষেতী ভীম, চাষী ভীম, হুলা ভীম ইত্যাদি এবং ঐতিহাসিক ভীম তথা কৈবর্তরাষ্ট্র বরেন্দ্রভূমির ট্রাজিক নায়ক ভীম। [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]
পৌরাণিক ভীম: পৌরাণিক ভীমের সঙ্গে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী বা জয়া একাদশীর নিবিড় যোগ আছে। এ বিষয়ে পুরাণ প্রমাণ উদ্ধৃত করা যায়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ভবিষ্যোত্তর পুরাণে এই তিথিকে জয়া একাদশী বলা হয়েছে। এই একাদশীর এটি আদি নাম। পদ্মপুরাণে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে পাণ্ডবনির্জলা একাদশী তথা ভীমসেনী একাদশী নাম দেওয়া হয়েছে। গরুড়পুরাণে মাঘমাসের শুক্লপক্ষের একাদশীকে ভৈমী একাদশী বলে অভিহিত করা হয়েছে। জয়া একাদশীর কিভাবে
সহনাম ভৈমী একাদশী হল তা পুরাণের কাহিনী বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।
প্রথমে জয়া একাদশীর কথায় আসা যাক। শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদ ও ব্যাসদেব-ভীমসেন সংবাদে বিশদে বলা হয়েছে।
জয়া একাদশী ব্রত পালন করলে সর্বপাপের বিনাশ হয়,সর্বকামনা ফলদায়ক হয়,মানুষ সহজে মোক্ষ লাভ করে। বছরের চব্বিশটি একাদশীর মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ।
জয়া একাদশী ব্রতের সুফল বিষয়ক কাহিনী এরকম:
স্বর্গের পারিজাত কাননে দেবরাজ ইন্দ্র গন্ধর্ব-অপ্সরাদের নিয়ে নৃত্য-গীত উপভোগ করছিলেন।এমন সময় গন্ধর্ব চিত্রসেনের কন্যা পুষ্পবন্তী এবং গন্ধর্ব পুষ্পদত্তের পুত্র মাল্যবান পরস্পরে প্রেমাবেশে তালভঙ্গ করেন। দেবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের মর্তে পিশাচ -পিশাচিনীরূপে বাস করার অভিশাপ দেন। তখন তারা মনের দুঃখ নিয়ে হিমালয়ের শীতলতম পার্বত্য এলাকায় বাস করতে লাগলেন। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নির্জলা উপবাসে দুজনে কাটিয়ে দিল।অজান্তে জয়া একাদশীর তপস্যায় শ্রী বিষ্ণু সন্তুষ্ট হয়ে দুজনকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন, আর ইন্দ্র তাদের সসম্মানে গ্রহণ করলেন।
ব্যাসদেব-ভীমসেন সংবাদ অংশে ভীমের একাদশী পালনে সম্মত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কলিযুগে যাগ-যজ্ঞ ক্রিয়ানুষ্ঠানের দ্বারা তপস্যা সম্ভব নয়। তাই এ যুগে একাদশী পালনের তপস্যা ফলদায়ক। ভীম ভোজনরসিক। তার অপর নাম বৃকোদর অর্থাৎ বৃক নামক অগ্নি ভীমের উদরে বাস করে। তাকে অন্নাদির আহূতিতে সন্তুষ্ট করতে হয়। এ কারণে বছরে চব্বিশটি একাদশী পালন দূরের কথা ভীমের পক্ষে একবেলাও অনশনে থাকা সম্ভব নয়। ব্যাসদেব ভীমকে জানিয়েছিলেন, সব একাদশী পালনে যা হয়, এক জয়া একাদশী পালনে সেই ফল। স্বধর্ম রক্ষা এবং পাণ্ডব কল্যাণে তিনি এই একাদশী পালন করতে রাজি হন। এভাবেই জয়া একাদশী পাণ্ডব নির্জলা একাদশী তথা ভীমসেনী বা ভৈমী একাদশী নামে প্রচারিত হয়।
মহাভারতে ভীমের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
ভীম পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ সন্তান। ঋষি দুর্বাসার বরে পবন দেবকে প্রার্থনা করে কুন্তীদেবী ভীমকে জন্ম দেন। ভীম দ্বিতীয় পাণ্ডব(মধ্যম পাণ্ডব)।
ভীম অতুলনীয় দীর্ঘদেহী এবং অমিত শক্তিশালী। ভীমের কোন দাড়িগোঁফ ছিল না, শ্মশ্রুগুম্ফহীন বলে কর্ণ তাকে মাকুন্দ বলে পরিহাস করতেন। তাঁর গাত্রবর্ণ ছিল কাঁচা সোনার মতো। কাঁধ ছিল অত্যন্ত চওড়া,উন্নত বক্ষ।বলা হয় ভীমের দেহে অযুত হস্তীর বল। মস্তকে কোঁকড়ানো কেশ।
দ্রোণাচার্য তাঁকে অস্ত্র শিক্ষা দেন, বলরামের কাছে গদাযুদ্ধের তালিম তিনি নেন। শৈশবে নাগেদের হত্যা করেছিলেন। সেখানেই ভেষজ পান করার ফলে দেহের বিপুল শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। যেখানে অন্যায়, দুর্দমনীয় অশুভ শক্তি, অধর্ম মাথা চাড়া দিয়েছে সেখানেই দমনের জন্য ভীমের ডাক পড়েছে। দমনের শক্তিও সমাজে প্রয়োজন, ভীম তার স্পষ্ট উদাহরণ। ভীমহস্তে বধের তালিকা দীর্ঘ। বনবাসকালে হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করে তার বোন হিড়িম্বাকে বিবাহ করেনভীম। বকাসুর, জরাসন্ধ,দুঃশাসন,কীচক, জটাসুর,অশ্বত্থামা,ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রকে তিনি হত্যা করে ধর্ম রক্ষা করেন।
লৌকিক ভীম:কোমল জলবায়ুর দেশ বাংলায় এসে প্রায় সব দেবতাই আমাদের ঘরের লোক হয়ে যান। আমাদের মতো হাসেন কাঁদেন, সাধারণ আচার-আচরণ করেন। একেই বলি দেবতার লৌকিক রূপ। অন্য সংজ্ঞা আছে, এক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন।
মহাভারতের রাজকীয় ভীমসেনের একাদশী পালনের ঘটনার লোককাহিনী তার প্রমাণ।
কুন্তীদেবী একদিন একাদশী পালনের জন্য শীতে জলাশয়ে চান করেছেন। শীতে মাকে কাঁপতে দেখে ভীম রেগে গিয়ে লাঙলের ফলাকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত করে পুকুরের জলে ডুবিয়ে দিলেন। জলাশয়ে বরুণদেবের প্রাণান্তকর অবস্থা। তিনি বিষ্ণুর কাছে পরিত্রাণের জন্য ছুটে গেলেন। বিষ্ণু তাঁকে বললেন,”ভীম যদি একাদশী করে দেহের অগ্নির তাপ কমায় তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে। “বরুণের অনুরোধে ভীম তখন একাদশী পালন করলেন। এ হল ভৈমী একাদশীর লোককথা।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরাক্রমশালী ভীমের আর এক পরিচয় উঠে এল লোকজীবন থেকে–চাষী ভীম,ক্ষেতী ভীম। হুলাভীমও আছে। অনুমান করা যায়, ভীম শক্তিশালী পবনদেবের সন্তান হওয়ায় কৃষিজীবীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল বাঁচাতে তাঁর শরণাপন্ন হতে চেয়েছে। তাই তাঁকে ক্ষেত সংলগ্ন স্থানে পুজো করেন। এমন বলশালী বলেই না তিনি সকল উপদ্রবের রক্ষাকর্তা হতে পারেন।
ঐতিহাসিক ভীম:বাংলার ইতিহাসে পালবংশীয় রাজাদের উত্থান-পতনের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক ভীমের সম্পর্ক। নৈরাজ্য থেকে উদ্ধার পেতে পালরাজাদের উত্থান ঘটানো হয়েছিল। তাঁদের হাতেই বঙ্গে সুবর্ণযুগ এসেছিল। কিন্তু সে পুরানো গৌরব হারিয়েও গেল। পারিবারিক কলহ, সন্দেহ, ষড়যন্ত্র নামিয়ে আনলো আবার অরাজকতা। অরাজকতার দোসর অসন্তোষ দিকে-দিকে ঘনীভূত হতে লাগলো। এটা একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর সময়কালের কথা। দ্বিতীয় মহীপাল(১০৭০–১০৭১) তখন সিংহাসনে। তাঁর ভ্রাতৃদ্বয়,শূরপাল ও রামপাল বিদ্রোহ করেছেন, সামন্তরাও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। এমতাবস্থায় বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিহত হলেন মহীপাল। এই কৈবর্ত বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন কর্মচারী দিব্বোক। এই দিব্য বা দিব্বোক বরেন্দ্রী দখল করে কৈবর্ত রাষ্ট্র স্থাপন করেন।তাকে বারবার রাজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে। দিব্যর পর তাঁর ভাই রুদ্দোক রাজা হন, রুদ্দোকের পুত্র ভীম পরবর্তী রাজা।
যতদূর জানা যায়, এই ভীম বলশালী,জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। প্রথমবার ধর্মপালকে পরাজিত করলেও দ্বিতীয়বার পরাস্ত হন। ধর্মপাল ভূমি দান ও অঢেল সোনা দিয়ে বহু সামন্তদের সহযোগিতা পেয়ে যান। এমন কি ভীমের বন্ধু ও সহায়ক নায়ক হরিও বিশ্বাসঘাতকতা করে। ভীমের রাজকোষ লুঠ করা হয় এবং কৈবর্তদের বিদ্রোহ চিরতরে বন্ধ করার জন্য ভীম ও তার সমগ্র পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যগ্রন্থের বিবরণকে প্রামাণ্য বলে ধরতে হয়, কিছু শিলালেখ ও বিজয়স্তম্ভ ও সাহায্যকরী।
অনেকের মতে বাংলায় যে ভীম পূজিত হন, তা মহাভারতের ভীম নন, কৈবর্তরাষ্ট্র বরেন্দ্রভূমির নায়ক ভীম। তাঁরা যুক্তি দেন, মহাভারতের ভীমের গালপাট্টা ও গোঁফ নেই। এ ভীমের মূর্তিতে তা আছে। তবু কিছু প্রশ্ন থাকে।যেমন উত্তরবঙ্গের নায়ক দক্ষিণবঙ্গে বহুল পুজো পান কিভাবে? কৈবর্ত ভীমের একাদশী যোগ কেন? এটাও সমস্যা নয়, হালিক বা কৃষক কৈবর্তের সেন্টিমেন্ট যে কোন জায়গায় কাজ করতে পারে। মহানায়কের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য উপবাসকে গ্রহণ করতে একাদশী তিথিকে বেছে নেওয়াও যেতে পারে।
আমি পক্ষে বিপক্ষে বলার লোক নই, বিষয়ের উপস্থাপন করলাম মাত্র। বিচারের ভার পাঠকের হাতে।
উপসংহার: উপনিষদ বলছেন, নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। বলহীন কোন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথও প্রার্থনা করেছেন বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোর শকতি। সমাজ রক্ষায়, ধর্মরক্ষায়, আত্মরক্ষায় শক্তির সাধনা আবশ্যিক। উপনিষদে ঋষি শিষ্যকে বলেছিলেন, দ দ দ। দমন, দান, দয়া। আকাশের বিদ্যুতের শিক্ষা। ভীমের মধ্য এ গুনগুলি পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যে ভীমই হোন, এ শিক্ষা আয়ত্ত করার জন্যই পূজা। প্রণাম জানাই পরাক্রমশালী ভীম দেবতার চরণে। তিনি আমাদের বাক্য মন কায়ায় বিরাজ করুন।