রবীন্দ্র কর্মকার[সহ-সম্পাদক, স্থানীয় সংবাদ]: ২৯ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে তাঁর জন্মস্থান বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মাল্যদান করতে গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। ওইদিন ওখানে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষে একটি সরকারি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন মন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী, মন্ত্রী মানসরঞ্জন ভুঁইয়া, বিধায়ক অজিত মাইতি, জেলা শাসক আয়েশা রানি, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার প্রমুখ। যেহেতু সুকান্ত মজুমদার আগে ওই জায়গায় গিয়ে মাল্যদান করেছেন বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে, তাই অজিতবাবু ওই পুরো জায়গাটিকে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কথা বলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন বিজেপি ওই জায়গাতে যাওয়ায়, পুরো জায়গাটি অপবিত্র হয়ে গিয়েছে। তাই গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে পবিত্র করার কথা বলেন তিনি। শুধু তাই নয়, সুকান্তবাবু বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে যে মালা পরিয়েছিলেন তাও খুলে ফেলা হয় এবং বিদ্যাসাগরের মূর্তিটিকেও গঙ্গাজল দিয়ে ধৌত করা হয়। মহকুমার অনেক মানুষই এই ঘটনার কথা শুনে প্রকাশ্যে মতামত জানাতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে অনেকেই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। মানুষের বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি আমাদের মহকুমাতেও যখন কোনও নাবালিকাকে ধর্ষণ করার ঘটনা শোনা যায় তখন তো কোনও রাজনৈতিক দলকেই দেখা যায় না সেই ঘটনার প্রতিবাদ করতে। অথচ নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকায় বিদ্যাসাগরকেও সেই রাজনীতিতে টেনে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অনেকেই তাঁদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।
•রামকুমার দে (বিজেপির ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার সভাপতি): তৃণমূলের এটাই কালচার, এটাই সংস্কৃতি। নিজেরা শিক্ষায় দুর্নীতি, কয়লা, গোরু পাচার কাণ্ডে কালিমালিপ্ত হয়ে জেলে যাচ্ছেন, আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানে গেলেই অপবিত্র হয়ে যাচ্ছেন? বিদ্যাসাগর আমাদের ঘাটাল মহকুমার ভূমিপুত্র। তিনি সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর জন্মস্থানে যাওয়ার, তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করার সবার অধিকার রয়েছে। সে অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারেন না। এর থেকে শিশুরা কী শিখবে! গোটা সমাজ দেখেছে ওইদিনের তৃণমূলের ওই আচরণ। তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মানুষের মাথা নিচু করে দিয়েছে অন্যান্য রাজ্যের কাছে।
•কেশব মেট্যা (কবি): যাঁরা সেইদিন ওই জায়গাতে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের কাছে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন, এই কাজটা কতটা যুক্তিযুক্ত? তিনি তো একজন মহাপুরুষ, তাঁকে ছুঁয়েই তো মানুষ পবিত্র হবে। তাঁকে কোনও মানুষ, সেটা একজন নিম্নবর্ণের মানুষ হোক বা রাজনৈতিক নেতা ছুঁয়ে দিলে তিনি অপবিত্র হয়ে যাবেন এমন কথা তিনি হয়তো কখনও বলে যাননি। আবার আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কেউ তাঁর মূর্তিকে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে দিলেই তিনি পবিত্র হয়ে যাবেন এমনও কোনও কথা নেই। এটা কোনও অশিক্ষার প্রভাব এমনটা বলবো না, এটা আসলে কুশিক্ষা। কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল সে ঘটনার খবর আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের ঘাটালে, যেখানে বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানে এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে গেলো কিন্তু ঘাটাল মহকুমায় সেভাবে আলোড়ন ওঠেনি। আমাদের ঘাটালে অনেক বিদ্যাসাগর স্মরণ সমিতি, বিদ্যাসাগরের নামে সভা, আকাদেমি রয়েছে। তাঁরা সারা বছর বিদ্যাসাগর নিয়ে অনেক লেকচার দেন অথচ তাঁরাও আজ এই ঘটনার প্রতিবাদ না করে চুপ করে রয়েছেন এটা দেখেই অবাক হয়েছি। কোনদিকে এগোচ্ছে আমাদের সমাজ, ভবিষ্যত প্রজন্ম কী শিখবে এইসব ঘটনা থেকে?
•দিলীপ মাজি (তৃণমূল নেতা ও ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি): ওইদিন সরকারি অনুষ্ঠানের মাঝে মঞ্চে মন্ত্রীদের ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে বিজেপি বীরসিংহে যে নাটক দেখাল তা মহকুমার মানুষ দেখেছেন। যাঁদের বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাঁদের বীরসিংহে এসে বিদ্যাসাগরের প্রতি ভক্তিতে গদগদ হওয়াটা শোভা পায় না। সারা রাজ্য জুড়ে একটা গন্ডগোল লাগানোর যে প্রক্রিয়া বিজেপি চালাচ্ছে তা বীরসিংহেও করার চেষ্টায় ছিল। অজিতদার ধৈর্য্যের বাঁধ আর ধরে রাখা যায়নি। যার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ওইদিনের ওই ঘটনা।
•শর্মিষ্ঠা ঘোষ (প্রাইভেট টিউটর): অবশেষে বিদ্যাসাগরের মতো মহাপুরুষকে নিয়েও রাজনীতি? তিনি তো কখনোই কোনও দলের নাম উল্লেখ করে বলে যাননি যে তিনি একটি নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করেন। তাই আমার মনে হয় এই কাজ মোটেই ঠিক হয়নি। যে বা যাঁরা বিদ্যাসাগরকে রাজনীতিতে টেনে নামাল তাদের নিম্ন মানসিকতার মানুষজন বলেই মনে হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ, এটা সমগ্র বিশ্বের কাছে লজ্জা।
•উমাশঙ্কর নিয়োগী (প্রাবন্ধিক তথা নন্দনপুর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত বাংলার শিক্ষক): বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান বীরসিংহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে একটি তীর্থক্ষেত্র স্বরূপ। কারণ তাঁর যে সমাজ সেবামূলক কাজকর্ম, জনকল্যাণমূলক কাজ তা আমরা সবাই জানি এবং সেজন্য তিনি আমাদের কাছে মহাপুরুষ। তিনি কোনও নির্দিষ্ট একটি দলের নয়। তাই তাঁর জন্মস্থানে কোনও একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা গেলে যে সেই স্থান অপবিত্র হয়ে যাবে এমন কোনও কথা নেই। কারণ ওই স্থানটি কোনও রাজনৈতিক দলের একার নয়। তাছাড়া যে কেউ সেখানে যেতেই পারেন, তাঁকে প্রণাম জানাতে যেতে পারেন। তাই শাসক দলের এই কাজটি মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা নিতান্তই লোক দেখানো, নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার মতো একটি কাজ বলে আমি মনে করি।
•চিন্ময় পাল (সিপিএমের ঘাটাল এরিয়া কমিটির সম্পাদক): বিজেপিরও ওই সময় নিজেদের দলীয় পতাকা নিয়ে বীরসিংহে ঢোকা উচিত হয়নি। তবে তৃণমূল যেটা করল সেটা চরম নোংরামি। নোংরামি বললেও কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিটাকে একটা জঘন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল। বিদ্যাসাগরকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই স্পর্শ করতে পারেন। তার জন্য অপবিত্র হওয়ার কী আছে। চোর ছ্যাঁচ্চড়দের দল তৃণমূল। অজিত মাইতিও তার বাইরে নয়। বরং ওরা ছুঁতেই বিদ্যাসাগর অপবিত্র হল।
•বিকাশ কর (ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ): যাঁরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙে তাঁরাই বীরসিংহে এসে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মালা দেয়। ওইদিন বিজেপি একটা সরকারি অনুষ্ঠানের মাঝে গিয়ে যেভাবে অনুষ্ঠানটিকে পণ্ড করার চেষ্টা করেছিল তারই প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে অজিত মাইতি ওই কথাগুলি বলতে বাধ্য হয়েছেন। মহকুমার মানুষ ওইদিনের ঘটনাটিকে অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ।
•শশধর মণ্ডল (কংগ্রেসের ঘাটাল ব্লক সভাপতি): আমরা এই জিনিস সমর্থন করি না। আমরা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করি। আমাদের দলের নেতৃত্বরা কখনই এই ধরনের অশূচি, অপবিত্র, বিভেদমূলক কথা বলেন না। প্রত্যেকেরই গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও অধিকার রয়েছে। বরং সিপিএমের জমানায় কিছু নেতা ফতোয়া জারি করে বলতেন কংগ্রেসের ঘরে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। সেই ট্র্যাডিশন এখন তৃণমূল বহন করে চলেছে। আমি সবকিছু করব, আর অন্য কেউ করলেই অশূচি, অপবিত্র হয়ে যাবে, এই নীতির আমরা তীব্র ধিক্কার জানাই।