এই মুহূর্তে ক্রীড়া/অনুষ্ঠান অন্যান্য সাহিত্য সম্পাদকীয় নোটিশবোর্ড

E-Paper

‘দেবী সরস্বতী কথাঃ বৈদিক ও পৌরাণিক’ — অরূপরতন মিশ্র

Published on: February 4, 2022 । 10:07 AM

‘দেবী সরস্বতী কথাঃ বৈদিক ও পৌরাণিক’ — অরূপরতন মিশ্র
•দেবী সরস্বতী সনাতন ধর্মে বৈদিক যুগ থেকে পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে অধুনা কাল পর্যন্ত জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। এই সুদীর্ঘ কালে সরস্বতী বন্দনায় সনাতন ধারায় কিছু বিবর্তন চোখে পড়ে। বেদের মূলতত্ত্ব অনুসরণ করে পুরানে যে রূপকল্পনা ও রূপক কাহিনীগুলি রচিত

হয়েছে তা বর্তমান আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।
বৈদিক সরস্বতী: প্রথমে সরস্বতী নামটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জেনে নেওয়া যাক। সর:+ বতুপ +ঈ (স্ত্রী লিঙ্গে)। সর: শব্দের অর্থ জল বা জ্যোতির আধার, বতুপ্ অর্থে বিদ্যমান, আর তার সঙ্গে স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় দিয়ে নামশব্দটি হল ‘সরস্বতী’। এভাবে সরস্বতী শব্দের লক্ষণার্থ হলো, যে দেবীর মধ্যে জল বা জ্যোতির প্রবাহ বিদ্যমান তিনি সরস্বতী। পরমপুরুষের অনন্ত অনাদি জ্ঞানের অপ্রকাশিত ভাণ্ডার অপার

করুণা বলে বিগলিত হয়ে ধরিত্রীর বুকে সরস্বতী রূপে প্রবাহিত হচ্ছে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে রচিত সুপ্রাচীন ঋকবেদে সরস্বতী দেবতার কথা প্রথম পাওয়া যায়। আর্যাবর্তে প্রবাহিত সরস্বতী স্রোতস্বিনীকেই ঋষিরা বন্দনা করেছিলেন দেবীরূপে। দুর্ভাগ্যক্রমে সরস্বতী নদী বর্তমানে লুপ্ত । এই নদীর বাস্তবতা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেও কোনো কোনো গবেষক আর্কিওলজিক্যাল ও জিওলজিক্যাল সার্ভের মধ্য দিয়ে কিছু কিছু তথ্য এই নদী সম্পর্কে পেয়েছেন। তারা মনে করেন, এই নদীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে আর্যদের সম্পর্কে বহিরাগত বদনামের তত্ত্ব খারিজ হয়ে যাবে।
এই সরস্বতী নদীকেই আর্যরা তৎকালে প্রধান পবিত্র নদী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দেবী হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে আরাধনা করতেন। পরবর্তীকালে সনাতন ধর্মীয়দের কাছে গঙ্গা নদী উপাস্য। যাই হোক,আর্যরা এই পবিত্র সরস্বতী নদীর তীরে সাধনা করতেন, স্তোত্র রচনা করতেন, যজ্ঞ সম্পাদন হত, উদ্গীত মন্ত্রের ধ্বনি নদীর তীরে তীরে ছড়িয়ে পড়তো। সাধন সহায়কই নয়, সরস্বতীর স্রোত মানুষের জীবন-জীবিকারও সহায়ক হয়ে উঠেছিল। সাধনার সিদ্ধি এবং জীবকুলের জীবন রক্ষায় এক পরম কল্যাণময় ভূমিকা ছিল এই নদীর। তাই সরস্বতী শুধু নদী নয়, পরম ব্রহ্মের কল্যাণকামী শক্তি রূপে তাঁদের কাছে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছিল অনেক মন্ত্র বা সুক্ত। সরস্বতী নদী স্বাভাবিকভাবেই বাগদেবীতে পরিণত হলেন।
ঋগ্বেদের প্রথম, সপ্তম, অষ্টম ও দশম মন্ডলে সরস্বতী দেবতা নিয়ে অনেকগুলি সূক্ত পাওয়া যায়। তার মধ্যে বাগদেবী প্রতিষ্ঠার সমর্থনে প্রথম মন্ডল এর তৃতীয় সূক্তের ১১ ও ১২ ঋক দুটি প্রণিধান যোগ্যঃ
চোদয়ীত্রি সুনৃতানাং চেতন্তী সুমতিনাং
যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।১১
মহো: অন: সরস্বতী প্রচেতয়িতি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।। ১২
অর্থ: নিত্য সত্য প্রিয় বাক্যের উৎসস্বরূপিনী, সুমতি ব্যক্তির চেতনা প্রদায়িনী সরস্বতী দেবী আমাদের যজ্ঞ অভিলাষ করেছেন।।১১
প্রভূত জল সৃষ্টিকারীনি ও জ্ঞানের উদ্দীপনাকরিনী সমগ্র বিশ্বে বিরাজিত দেবী সরস্বতীর ধ্যান করি।।১২
বেদে ব্রহ্মশক্তি এবং দেবতাকে এক করে দেওয়া হয়নি। ব্রহ্মশক্তি একক, অবিনশ্বর, অনন্ত, অসীম, অশেষ। এই পরমশক্তি সৃষ্টির সমস্ত কিছুতেই বিরাজিত, পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, দ্যুলোকের যে যে প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখা যায় তা ব্রহ্মশক্তিরই প্রকাশ। প্রাকৃতিক বিষয়ে শক্তির বিশেষ প্রকাশকে ঋষিরা দেবত্ব ও চেতনত্ব আরোপ করেছেন। সেই অর্থে সরস্বতী নদী দেবতা এবং মানবজাতির জ্ঞান উন্মেষণে তাঁর কৃপা কামনা করেছেন।
কোন কোন ধর্মগুরু সরস্বতী কে বৈদিক দেবতা বলে স্বীকার করতে চান না, তাদের মতে তিনি পৌরাণিক দেবী। কিন্তু পুরাণের সরস্বতী সংক্রান্ত রূপক কাহিনী গুলি বিশ্লেষণ করলে বেদের মূলতত্ত্বের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয়। এবার আমরা পৌরাণিক সরস্বতী নিয়ে আলোচনা যাবো।
পৌরাণিক সরস্বতী:
আগেই বলেছি পুরাণের সঙ্গে বেদের একটা গঠনগত পার্থক্য আছে। বেদে এক এবং অদ্বিতীয় ঐশ্বরিক শক্তিকে বহুরূপে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে লক্ষ্য করা হয়েছে এবং সেই সব বিষয়ে চেতনত্ব আরোপ করা হয়েছে। পুরাণে সেই শক্তির রূপবিকাশকে তত্বভিত্তিক অবয়ব বা রূপ দেওয়া হয়েছে এবং তৎসংক্রান্ত রূপক কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে। সব দেবতার মতো পৌরাণিক স্বরস্বতী দেবতা ব্যতিক্রমী নন।
দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি ও পরিবার:
আমরা সনাতন ধর্মের মানুষেরা পরিবার দেখতে ভালোবাসি। তাই পিতা-মাতা -স্ত্রী -পুত্র-কন্যা ইত্যাদি নিয়ে দেবতাদেরও লৌকিক সংসার গড়ে দিয়েছি। স্বরস্বতীর লৌকিক পরিবার গঠন করতে গিয়ে পুরানে- পুরানে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। পুরানকারগণ যে যাঁর মতো করে সরস্বতী চিন্তাকে স্বাধীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোন কোন পুরান মতে, যেমন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে সরস্বতী দেবী ব্রহ্মার মুখগহ্বর থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন। পাশাপাশি পদ্মপূরাণে সরস্বতী কে দক্ষকন্যা বলা হয়েছে। আবার দেবীভাগবত পুরাণে দেখা যায়, সরস্বতীর সৃষ্টি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে। সুতরাং সরস্বতীর সঠিক পিতা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক মৎস্যপুরাণ পরমাত্মার মুখনিঃসৃত শক্তির মধ্যে সরস্বতীকে প্রধান বলেছেন।
সরস্বতীর স্বামী নিয়েও একইভাবে পুরানকারদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মত পরিলক্ষিত হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে তিনি বিষ্ণুপত্নী, দেবীভাগবত পুরাণ মতে ব্রহ্মার পত্নী, স্কন্দ ও শিবাপুরাণে শিবের ঘরনী, পদ্মপূরাণে কশ্যপ মুনির স্ত্রী। সুতরাং দেবী সরস্বতীর স্বামী নিয়েও ঘোর সংশয়।
পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আগেই বলেছি দেবতাদের পরিবার একটি কল্পনা এবং পুরানকারদের স্বতন্ত্র প্রতীক চিন্তা এরকম প্রভেদের মূল কারণ। কিন্তু কোনভাবেই তাঁরা কেউই বৈদিক মূল সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। সেটা কিভাবে? দেবতাদের পিতা -পতি কিছু হয় না। একই শক্তির ভিন্ন প্রকাশ। নিত্য সত্য জ্ঞানের আকর স্বয়ং ব্রহ্ম’। সেই ব্রহ্ম’ শক্তিকে মহাব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সময় ত্রিধাবিভক্ত করা হয়েছে — সৃষ্টি-স্থিতি-লয় (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর)। মহাসৃষ্টির জ্ঞান তথা ব্রহ্মার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে বিষ্ণু তথা পালন কর্তার জিহ্বাগ্র দিয়ে ঐশী জ্ঞানধারা সরস্বতী রূপে ধরায় প্রবাহিত হয়েছে। যা ছিল স্তব্ধ,হিমালয়ের মতো অটল -অচল, তাই হল নির্ঝরিনী। আর্য ঋষিরা মননের দ্বারা সেই জ্ঞান ধারণ করলেন আর বাঙ্ময় হয়ে শিষ্য শিষ্যান্তরে দান করে গেলেন। এই হল সরস্বতী দেবীর উৎপত্তি ও পরিবারের গূঢ় তত্ত্ব।
দেবী সরস্বতীর রূপকল্পনা বা মূর্তি-রহস্যঃনিরাকার সাধনা সাধারণ মানুষে পক্ষে সহজ নয়।এজন্যই ঋষিরা অসীমকে সীমায় বাঁধতে প্রতিমার রূপ দেন।জ্ঞান- সাধনার উপযোগী প্রতিমূর্তি সরস্বতী প্রতিমা তাঁদেরই ধ্যানোপলব্ধি।
দেবী সরস্বতী প্রতিমা সব পুরাণেই চতুর্ভুজা। তবে বাংলা তথা পূর্ব ভারতে দ্বিভূজা দেখা যায়। পুরাণ অনুসারে দেবীর চার হাতে অক্ষমালা, পুঁথি, বীণা,পদ্মফুল সহ বরাভয় মুদ্রা থাকে। এই চতুর্ভুজ চতুর্বেদের প্রতীক কিংবা মন,সচেতনতা, বুদ্ধি বৃত্তির পরিচয়।
অক্ষমালার মাধ্যমে সারস্বত সাধনায় ত্যাগ,সংযম,একাগ্রতা ও নিরাসক্তির প্রয়োজনীয়তাকে বোঝানো হয়েছে। পুঁথি বা পুস্তক পরা ও অপরা বিদ্যায় সম্যক জ্ঞানের আবশ্যিকতাকে সূচিত করে।বীণাযন্ত্রের অপূর্ব সুরমূর্ছনা মহাজগতে বিস্তারিত পারমার্থিক আনন্দের প্রতীক। বরাভয় মুদ্রা ও পদ্মফুলে শুদ্ধ জ্ঞানার্জনে একনিষ্ঠ সাধকের প্রতি দেবীর পরম আশ্বাস ব্যক্ত।
দেবীর নিকট যে যবের শীষ আর আম্রমুকুল রাখা হয় তা নদী বিধৌত উর্বর ভূমিতে কৃষিবিদ্যা ও উদ্যানবিদ্যাকে নির্দেশ করে। লেখনী ও মস্যাধার লিপিকৌশলে দক্ষতা অর্জনের ইঙ্গিত বহন করছে। পুরোহিত মন্ত্র বলেন,”….. সরস্বতী পরিবারেভ্য নমঃ”। আসলে দেবীর এগুলি নিয়েই পরিবার। পরিবারের আর এক সদস্য হল তাঁর বাহন।
বাহন রহস্যঃ প্রাচীন ভারতের মূর্তিতে দেবী সিংহপৃষ্ঠে আসীনা। মনে হয়, সরস্বতী নদীতীরের অরণ্যে সিংহের অস্তিত্বের প্রভাব বাহন নির্বাচনে পড়েছে। তাছাড়া সিংহ বলবত্তা, বীর্যবত্তা, লক্ষ্যজয়ে কঠোর সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। তবে পৌরাণিক যুগে বাহনের পরিবর্তন ঘটেছে। স্থানভেদে পার্থক্যও আছে। উত্তর -দক্ষিণ ভারতে সরস্বতী ময়ূরবাহনা। পূর্বভারতে তিনি হংসারূঢ়া। হংসবাহনে বায়ুপরাণের সমর্থন আছে। হংস হল গতির প্রতীক। হাঁস ডাঙায় হাঁটে, জলে সাঁতার কাটতে পারে, আবার শূন্যে উড়তে পারে। অর্থাৎ পৃথিবী, অন্তরীক্ষ এবং দ্যুলোকের জ্ঞান তার করায়ত্ত। মহাবিশ্বের মহাজ্ঞানের আসনে দেবীর অধিষ্ঠান। সাধককে হতে হবে রাজহাঁসের মতো অপরা বিদ্যার মধ্যে থেকে পরাবিদ্যা গ্রহনে সক্ষম।
দেবীর বর্ণবৈশিষ্ট্যঃ প্রার্থনা মন্ত্রে বলা হয়েছেঃ
যা কুন্দেদুতুষারহারধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা।
যা বীণাবরদণ্ডমণ্ডিতভূজা যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা।।
দেবী সর্বশুক্লা—গাত্রবর্ণ, বস্ত্র,অলঙ্কারাদি, বীণা,পদ্ম,সব কিছুই সাদা, নির্মল।
পদ্মপুরাণে স্তবমন্ত্রে বলা হয়েছেঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষশুভ্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কার শোভিতা।।
কিন্তু শিবপুরাণমতে দেবী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে তিনি শুভ্রবসনা নন, পীতবসনা। স্কন্দপুরাণে দেবীর মস্তকে জটা এবং নীলগ্রীবা।
নামরূপঃ দেবী বহু নামে বন্দিত—–সরস্বতী,সারদা, মহাশ্বেতা,শতরূপা,ভারতী, বীণাপানি, বাণী, সনাতনী, বাগ্দেবী, বাগীশা, বাগীশ্বরী, বাঙ্ময়ী,বিদ্যাদেবী,গীর্দেবী,কাদম্বরী,সর্বশুক্লা।
উপসংহারঃ মানুষ মরণশীল, কিন্তু তার বড় পরিচয় যে সে মননশীল। তার মধ্যে সুপ্ত হয়ে আছে অসীম শক্তি। জাগতিক মোহমায়ার আবরণ ছিন্ন করে নিত্য সত্য লাভ করে দেবত্বে উত্তরিত হতে পারে। মহীয়ান অমৃত জ্ঞানের স্তব্ধতার তপস্যা ভঙ্গ করে আলোকের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করতে পারে।বসন্ত পঞ্চমীর পুণ্যলগ্নে জ্যোতির্ময়ী দেবী সরস্বতীর নিকট অমৃতের পুত্রদের একটাই প্রার্থনা হোকঃ
সকল বিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।

সৌমেন মিশ্র

পাঠকের কাছে তথ্য ভিত্তিক সত্য সংবাদ পৌঁছে দেওয়াই আমার দায়িত্ব। মোবাইল-৯৯৩২৯৫৩৩৬৭

Join WhatsApp

Join Now

Join Telegram

Join Now