তৃপ্তি পাল কর্মকার: বাড়ছে পরকীয়া। আজকের দিনে যেন একটু বেশিই ভাঙছে সাজানো সংসার। হাতে মুঠোফোন। হাতের নাগালেই দুনিয়া। দুনিয়ার সব কিছুকে নিমেষে কাছে এনে দেবার মাধ্যম তো এই মুঠোফোন! অনেকটা যেন আরব্য রজনীর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ! অনেক অসাধ্যকে সাধন করে দেয়। তার মধ্যে একটি অসাধ্য সাধন হল ঘরের মানুষের সঙ্গে মনের মিল না হলে, মতের মিল না হলে আবার মনের মতো কাউকে খুঁজে নেবার কাজটিও হয়ে যাচ্ছে মুঠোফোনেই। ফোনেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে পুরোনো প্রেমিক প্রেমিকাকে। উটকো কল থেকেও জুটে যাচ্ছে নতুন শয্যা সঙ্গী বা সঙ্গিনী। বয়স বাধা নয়। মনের ইচ্ছে থাকলেই হল। সন্তানের বয়স এককুড়ি ছুঁতে চলল এমন ছেলে মেয়ের মা বাবারাও মজে যাচ্ছে পরকীয়ায়। কখনও পরকীয়ার সঙ্গী পুরোনো প্রেমিক-প্রেমিকা, কখনও নতুন কেউ।
তবে সব দোষ মুঠোফোনকে দিয়ে লাভ নেই। মুঠোফোনের জন্যেই যে পরকীয়ার দাপট এমনটাও বলা যায় না। পরকীয়া যুগে যুগে ছিল। আজকেও আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকার বিখ্যাত প্রেমটিও ছিল পরকীয়া প্রেম। সম্পর্কে তাঁরা মামি আর ভাগ্নে। রাধিকার প্রতি স্বামী অয়ান ঘোষের উদাসীনতাই ছিল বিখ্যাত এই পরকীয়ার কারণ। আজকেও আমরা শ্রীকৃষ্ণের পাশে রাধিকার পুজো করি। প্রকারান্তরে বলা যায় এই পরকীয়া প্রেমটি সমাদরেই পুজা পায়। বলা হয় শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির আধার রাধিকাসুন্দরী।
মহাভারতের যুগে বহু পরকীয়ার নিদর্শন রয়েছে। সে সময় সমাজ মেনে নেওয়া পরকীয়া জাত সন্তানের উদাহরণ তো ভুরি ভুরি। স্বামী অক্ষম হলে বা বংশ বিলোপের সম্ভাবনা থাকলে কোনও রমণীর গর্ভে পরপুরুষ দিয়ে সন্তান উৎপাদন করা হত। এই ক্ষেত্রজ সন্তান তার মায়ের বিবাহিত স্বামীর পরিচয়েই বড়ো হত। তৎকালীন সমাজে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন দোষের ছিল না। এই ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে হলে মাকে পরকীয়ায় মজতে হত। সুতরাং পরকীয়ার দাপট বিভিন্ন রকমভাবে চলে এসেছে যুগে যুগে। আজ মুঠোফোনের দৌলতে পরকীয়ার পথ মসৃণ হয়েছে এটা অবশ্যই বলা যায়। কারও ঘরে স্বামী বা স্ত্রী বাড়িতে নেই, সেটি পরকীয়ার সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিমেষে জানিয়ে দিয়ে সুখশয্যার কাজটি মসৃণ করে দেয় তো এই মুঠোফোন! পরকীয়ায় নিন্দার ঝড় ওঠে। গ্রাম্য সমাজে নানান শাস্তির বিধানও রয়েছে। গ্রাম্য সালিশি বা থানা পুলিশ যাই হোক, পরকীয়ার দাপট কমানো সম্ভব হয়নি। সমাজও আস্তে আস্তে পরকীয়ার ব্যাপারে নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছে। আসলে চোখের সামনে এতো আকছার ঘটছে পরকীয়ার ব্যাপারগুলো, যে মানুষ আর আলোচনার মধ্যেই আনতে চায় না। পাড়াতুতো বউগুলি তাদের চেনাজানা দেওর, ভাসুরপো, ভাগ্না বা নন্দাইয়ের হাতটি ধরে টুপ করে কেটে পড়ছে—এ তো আকছার হচ্ছে। কেউ বাচ্চার মায়া না কাটতে পেরে বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে, কেউবা বাচ্চা রেখেই চম্পট দিচ্ছে। এমনকি ১৭-১৮ বছরের ছেলে মেয়েকে বাবার জিম্মায় রেখে মা নাগরের সঙ্গে স্রেফ যৌন তাড়নায় কেটে পড়েছে এমন উদাহরণ কত চাই? অনেকে যাবার আগে পাড়াপড়শিকে নির্লজ্জের মতো জানিয়েও দিয়ে যাচ্ছে তাদের এই পরকীয়ার কারণ স্বামীর অক্ষমতা। বিপরীতেও তাই হচ্ছে। স্ত্রীর ওপর অভিযোগের আঙুল তুলে অন্য নারীর হাত ধরছে স্বামী।
নানান কারণ রয়েছে পরকীয়ার। কারও হয়তো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দৈনন্দিন ঝগড়াঝাটি-মারামারি লেগেই থাকে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়ে অনেকে নতুন সঙ্গী খুঁজে নেয়। অর্থনৈতিক সংঘাত থেকেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে এমন নজিরও আছে। সৌন্দর্যের কারণেও আসক্ত হয়ে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ তো আছেই। তবে সবচাইতে জোরালো পরকীয়ার কারণটি হল অতৃপ্ত যৌন তাড়না। ইদানিং মানুষের কোনও কিছুতেই আর লজ্জাবোধ নেই। অতৃপ্ত বাসনা নিজের মধ্যে আর রাখতে না পেরেই মানুষ নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে পরকীয়ায়। অনেকে আবার দুকূল ধরে রাখতে চায়। নিজের সংসার আর পরকীয়ার মধ্যে একটা সমঝোতা করে দুটোই বজায় রাখতে চান। সোশ্যাল মিডিয়ায় দাপটে তো এমন সম্পর্ক আকছার ঘটছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা পরকীয়ার তাল অচিরেই কেটে যায়। ভার্চুয়াল জগত আর বাস্তবের ভিত্তিভূমি আলাদা বুঝতে পেরে কিছু দিন পর দু’তরফই কেটে পড়ে।
জানাজানি হলেই পরকীয়ার ভয়ঙ্কর রূপটা দেখা যায়। ছারখার হয়ে যায় সাজানো সংসার। দম্পতির সন্তান অসহায় হয়ে পড়ে। বাবা বা মায়ের বিরুদ্ধে বহু নোংরা কথা শুনতে-শুনতে নানান মানসিক সমস্যা এসে যায় সন্তানের। যেহেতু পরকীয়ার কোনও বাঁধাধরা বয়েস নেই, তাই টিনএজ উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরাও চোখের সামনে বাবা মার পরকীয়া দেখতে দেখতে নিজেরাও সেক্সুয়্যাল ডিসঅর্ডারের শিকার হয়। এই ছেলে মেয়েরা মনের গহীনে অনেক কষ্ট লুকোতে লুকোতে সারাজীবনের জন্য বাবা-মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা সঞ্চয় করে নেয়।
পরকীয়া থেকে বেরোনোর সত্যি কি উপায় নেই? কেন নেই। নিশ্চয়ই আছে। সংসারের এক ঘেঁয়েমি থেকে কিছুটা সময় বার করে সাধ্যের মধ্যে পরিবারকে নিয়ে কাছাকাছি ঘুরে আসা। পরিবারকে সময় দেওয়া। এবং সর্বোপরি যদি মনে হয় সন্তানের সুন্দর মানসিক বিকাশের জন্য বাবা মা উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে,তাহলেই পরকীয়া আসক্তরা সংসারে মন দিতে পারে। আর সবচাইতে বড়ো কথা হল ‘বুঝলে আপ/ না বুঝলে কার বাপ?’ নিজে না বুঝলে কারো বাপের সাধ্য নেই বুঝিয়ে একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে একটা সম্পর্ক থেকে বার করে আনে। সুতরাং সবটাই নিজের কাছে।
👆 আমাদের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলটি লাইক করুন