‘ঘাটাল মহকুমা ও সুভাষচন্দ্র বসু’
উমাশঙ্কর নিয়োগী: ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে যুব সম্মেলন উপলক্ষে সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম মেদিনীপুরে আসেন। সঙ্গী ছিলেন কংগ্রেসের শীর্ষ স্থানীয় নেতা মৌলভী জালালউদ্দিন হামেসি। সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুব সমাজকে তথা ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এর সদস্যদের যুক্ত করে উৎসাহিত করা। ইতিপূর্বে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীকে নবরূপে সংগঠিত করেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হেমচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক এই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ঘাটাল মহকুমার জাড়ার কিশোরীপতি রায়, সাতকড়িপতি রায়, দাসপুরের কলাইকুণ্ডুর ভবানীরঞ্জন পাঁজা, কেঁচকাপুরের রামমনোহর সিংহ, ঘাটালের যতীশচন্দ্র ঘোষ, মনোতোষণ রায়, রাধাকান্তপুরের স্বদেশরঞ্জন দাস, মোহিনীমোহন দাস প্রমুখ ঘাটালের বহু নেতা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রামজীবনপুরের পুরানো হাটতলায় বামনঠাকুরের বাড়িতে, ঘাটালে, কুশপাতায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কেন্দ্র গড়ে উঠে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জেলবন্দি থাকার সময় থেকে কিশোরীপতির সঙ্গে সুভাষচেন্দ্রর পরিচয় হয়।
সাতকড়িপতি রায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সহ সম্পাদক হয়েছিলেন। সভাপতি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কিশোরীপতির ভাই সাতকড়িপতির সঙ্গেও বহু দিনের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল সুভাষচন্দ্রের।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন দাসপুরের চেঁচুয়া হাটে অত্যাচারি দারোগা ভোলানাথ ঘোষ ও ছোট দারোগা অনিরুদ্ধ সামন্তকে জনতা হত্যা করে। ৬ জুন ব্রিটিশ পুলিশ ১৪ জন আন্দোলনেকারীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নেয়। বহু মানুষকে বন্দি করে পুলিশ। আসামিদের হয়ে সওয়াল করতে মেদিনীপুর এসেও বীরেন্দ্রনাথ শাসমল অসুস্থতার কারণে সওয়াল করতে পারেননি। মেদিনীপুর কোর্টের রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে আসামি পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করা হয়। কিন্তু মামলা চালানোর অর্থ জোগান দেওয়া অসম্ভব বুঝে ঘাটাল থেকে মনোতোষণ রায়, হৃষীকেশ ভট্টাচার্য, রাজেন ভট্টাচার্য ও বিপিনচন্দ্র সামন্ত সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে আসামিদের অবস্থা জানান। সুভাষচন্দ্র বসু এই মামলা চালানোর সমস্ত আর্থিক দায় গ্রহণ করেন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসেরও সভাপতি পদে বৃত হন। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন কেঁচকাপুরের রামমনোহর সিংহ। সুভাষচন্দ্রের পাশে বসে কমিটির বহু আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকেছেন দেবেন্দ্রলাল, রামমনোহর। সুভাষচন্দ্র এঁদের কাছ থেকে ঘাটাল মহকুমার নিয়মিত খোঁজ নিতেন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বার মেদিনীপুরে এলেন ঘাটালের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে। দেবেন্দ্রলালের আগ্রহাতিশয্যে ২ মে মেদিনীপুর আসেন। অতিথি হিসেবে রাত্রি বাস করেন মেদিনীপুরস্থিত নাড়াজোলের রাজবাড়িতে। এখানে রাজ পরিবারের সদস্যদের সামনে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন তিনি। ৩ মে ঘাটালে আসার জন্য ট্রেন যোগে রোড চন্দ্রকোণায় আসেন। ওখান থেকে গাড়িতে ঘাটালে। সুভাষচন্দ্রের আগমনকে সামনে রেখে ঘাটালবাসীর তরফ থেকে একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়। লিফলেটটি ছিল এই রকম:
‘‘আগামী ২০শে বৈশাখ ইংরেজী ৩রা মে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু ঘাটালে শুভাগমন করিবেন। উক্ত দিবসে বেলা ৩টায় রাষ্ট্রপতি চন্দ্রকোণা রেলওয়ে স্টেশনে অবতরণ করিয়া ঘাটালের পথে বেলা ৪ টায় চন্দ্রকোণা মোড়, সাড়ে চারটায় কালিকাপুর, ৫ টায় রাধানগর অতিক্রম করিয়া ৫টা ৩০মিনিটে বড়দা বিশালাক্ষী মন্দিরে উপস্থিত হইবেন। অতঃপর বিরাট শোভাযাত্রা সহ রাষ্ট্রপতি ঘাটাল, কৃষ্ণনগর সভা মণ্ডপে উপস্থিত হইবেন। এই মহতী জনসভায় বিভিন্ন সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন ও মানপত্র প্রদান করা হইবে। এই দেশবরেণ্য নেতা ও মহামান্য অতিথিকে যথোচিত সম্বর্ধনা ও সম্মান প্রদর্শন করা ঘাটাল মহকুমা বাসী জনসাধারণের প্রধান ও অবশ্য কর্তব্য।
এই কারণে আমাদের অনুরোধ, ঘাটাল মহকুমার জনসাধারণ উক্ত দিবসে রাষ্ট্রপতির আগমন পথ পার্শ্বস্থ গৃহ দোকানদানী পত্র পুষ্প পল্লবে ও জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করিবেন। রাষ্ট্রপতির আগমন প্রাক্কালে পুরনারীগণ গণশঙ্খধ্বনি করিবেন এবং যথাশক্তি লাজপুষ্প তোষণ করিবেন এবং নিজ নিজ গৃহগুলি আলোকজ্জ্বলে সজ্জিত করিবেন।
ইতি ১৪ই বৈশাখ ১৩৪৫সাল।
বিনীত অভ্যর্থনা কমিটির পক্ষে—আশুতোষ চৌধুরী, মোহিনীমোহন দাস, আশুতোষ সিংহ, ড: হরনাথ দোলই, যতীশচন্দ্র ঘোষ, হরিসত্য রায়, ভবানীরঞ্জন পাঁজা, নৃপেন দাস, মনোতোষণ রায়, রামমনোহর সিংহ, লক্ষ্মণ সরকার, সুধীরপতি রায়, হরিসাধন পাইন, হৃষীকেশ পাইন, মণিকাঞ্চন বক্সী, গোবিন্দচন্দ্র দাস।”
চন্দ্রকোণা শহরের কেউ ব্রিটিশ বিরোধিতার ভয়ে সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানায়নি। কালিকাপুর গ্রামে এলে সহস্রাধিক মানুষের জয়ধ্বনি তাঁকে বরণ করে নেয়। রামমনোহর সিংহের দেওয়া রুপোর থালায় করে মানপত্র তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলন রামজীবনপুর বাবুলাল ইনিস্টিটিউটের ছাত্র সত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়। এই অপরাধের তাঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কৃতও করা হয়। কালিকাপুরের সেই ঐতিহাসিক স্থানে নেতাজির একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। যে মানপত্র তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় সেটি ছিল অনুরূপ:
‘‘রাষ্ট্রপতি
শ্রীযুক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু
শ্রদ্ধাভিনন্দিতেষু
হে বরেণ্য দেশনায়ক!
নানাভাবে নিপীড়ত নির্যাতিত মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমার অধিবাসীবৃন্দ আজ তোমার সান্নিধ্য লাভ করিয়া গর্বে ও আনন্দে অভিভূত। হে বাংলার বীর মাতৃসাধক। তুমি আমাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্ৰহণ কর।
হে চির নিপীড়িত তরুণ বাংলার প্রাণ !
লাঞ্ছিত জাতির মর্মবেদনা শৃঙ্খলিত মানবের অন্তরের জ্বালা তোমারই দ্বারা দিকে দিকে ধ্বনিত হইয়াছে , তাই সরকারের রোষকষায়িত রক্তচক্ষু বারে বারে তোমার উপর তীব্রভাবে নিপতিত হইয়াছে, কিন্তু তোমার শৌর্য, প্রতিভা, অপরাজেয় স্বাধীন চিত্ততা, অদম্য দৃঢ়তা ও অনন্যসাধারণ তেজস্বিতার নিকট তাহা তৃণের ন্যায়ই ভাসিয়া গিয়াছে , তুমি শৈলাপহত নির্ঝরের মতই দুর্দ্দম বেগে পথের সমস্ত বাধা দলিয়া পিষিয়া আপনার চলার পথ রচনা করিয়া গিয়াছ – হে বীর তোমাকে নমস্কার।
হে নির্ভীক কর্ম্মযোগীন্!
নিখিল ভারতের রাষ্ট্রক্ষেত্রে বাংলার ত্যাগ ও সাধনা যখন উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত, তখন তুমিই অকম্পিত কণ্ঠে অবমাননার প্রতিকার চাহিয়াছিলে। তরুণ বাংলা আজও মুগ্ধ চিত্তে তাহা স্মরণ করে। হে দুঃখব্রতী সাধক! সে দুঃখের মন্থন বেগে আজ যে অমৃত উত্থিত হইয়াছে, তাহা যোগ্য পাত্রেই অর্পিত হইয়াছে , হে রাষ্ট্রপতি সুভাষ চন্দ্র! সমগ্ৰ বঙ্গের সাথে তুমি আমাদের শ্রদ্ধাভিবাদন গ্ৰহণ কর।
হে তরুণ তাপস!
জাতি যে যজ্ঞের পৌরোহিত্যে তোমাকে বরণ করিয়াছে, সে যজ্ঞে দীন রামজীবনপুরবাসী উপকরণ সম্ভার অতি সামান্য, কিন্তু সামান্য হইলেও আমাদের সমস্ত আন্তরিকতায় তাহার অভাব ভরিয়া দিবার দুঃসাহসীকতা লইয়া তোমার সম্বর্ধনায় অগ্ৰসর হইয়াছি। আমাদের এক আশা, তোমার শুভাগমনে আমাদের নবজাগরণ ঘটিবে, তোমার বিজয়মন্ত্র আমাদের অন্তরে নবশক্তির বোধন আনিবে তোমার প্রদীপ্ত উৎসাহবাণী আমাদের বুকে নবপ্রেরণার নূতন অধ্যায় রচনা করিবে।
হে চিন্তাশীল মণীষী!
আজ মাত্র বঙ্গের নহ্, সমগ্ৰ ভারতের গৌরব তুমি, ভারতের বহুতর সমস্যা বহুদিক দিয়া পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছে, আন্তর্জাতিক জগতেও নানা জটিলতর সমস্যা দেখা যাইতেছে। হে দূরদর্শী! তোমার চিন্তাধারা ভারতকে এ সকল সমস্যা হইতে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করিয়া সুনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়িয়া তুলুক, তোমার মুক্তি সংগ্ৰাম দেশবাসীকে সুপরিচালিত করুক, তোমার সাধনা সফল হউক, সার্থক হউক।
বন্দেমাতরম্
কালিকাপুর। রামজীবনপুরের অধিবাসীবৃন্দ (ঘাটাল মহকুমার পক্ষে)
৩০শে এপ্রিল ১৯৩৮।
শ্রী সরস্বতী প্রেস। কলকাতা।’’
বড়দা বিশালাক্ষী মন্দির থেকে দূর্বাচটির মাঠের মঞ্চ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু পদব্রজে শত শত মানুষের অভিবাদনে অভিষিক্ত হতে হতে গিয়েছিলেন। দূর্বাচটির মাঠে হাজার হাজার মানুষের বিশাল জনসমাবেশে তিনি উদ্দীপক ভাষণ দেন। মঞ্চে তাঁর পাশে আসীন ছিলেন ঘাটাল মহকুমার প্রথম সারির কংগ্রেস নেতৃত্ব । সভা শেষে তিনি মেদিনীপুরে ফিরে যান।
নাড়াজোলের রাজ পরিবার, কেঁচকাপুরের সিংহ পরিবারের কাছে নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত বেশ কিছু ফটোগ্রাফ ও নথি আছে। এগুলো সংরক্ষণ করা আশু প্রয়োজন।
সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি রক্ষার্থে কালিকাপুর থেকে ঘাটাল পর্যন্ত রাস্তাটিও নেতাজির নামে করা যায় কিনা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন।