‘এই সময় যদি ভোটে দাঁড়াতেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’ —শ্রীকান্ত পাত্র, বিশিষ্ট সাংবাদিক
এই সময় যদি ভোটে দাঁড়াতেন রবীন্দ্রনাথের দেশনায়ক আমাদের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ? এক কথায় উত্তর, তিনি হেরে যেতেন। গো হারা হেরে যেতেন। আপনারা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হতে পারেন বা নাও হতে পারেন। ভাবছেন, কেন? সে কথায় আসি।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কে ছিলেন, কী ছিলেন, কী করেছিলেন তা আমরা সবাই জানি। এই ক’দিন আগে আমরা ভারতের নাগরিকরা দেশবাসীরা [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]ঘটা করে তাঁর ১২৬ তম জন্মদিন পালন করলাম। তাঁর সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা আওড়ালাম। আমরা মানে এই আম জনতা নেতাজি অনুরাগী ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা সভা সমাবেশ করে নেতাজির গুণগান গাইলেন। এমনকি নেতাজিকে সামনে রেখে একে অপরকে বোঝাতে চাইলেন ‘তোমার বা তোমাদের থেকে নেতাজিকে আমি বা আমরা বেশি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।’ এই ধরুন বিজেপি নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর তৃণমূল নেত্রী আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কী নাই গলা ফাটালেন নেতাজিকে নিয়ে। আর সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক তাঁরাও কম আকচা আকচি করেনি নেতাজিকে নিয়ে। কে কত বড় নেতাজি প্রেমী তা দেখাতে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন গত ২৩ জানুয়ারি। ধরেই নেওয়া হচ্ছে নেতাজি আজও জীবিত আছেন। আচ্ছা এই ১২৬ বছর পরও ধরে নেওয়া হচ্ছে তিনি জীবিত আছেন। ২০০বছর পরও কেউ কি বলবেন নেতাজি এখনও বেঁচে আছেন? কেউ বলবেন তিনি বেঁচে আছেন, কেউ বলবেন নেতাজি মনে হয় আর বেঁচে নেই। অনেকেই তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবেনই। কেননা, তাঁর মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই। জাপানের রেনকোজি মন্দিরে যাঁর ছাইভস্ম রয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে তিনি কি আদৌ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু? এ নিয়ে অনেক কমিশন ফমিশন হয়েছে। কিন্তু আজও প্রমাণিত হয়নি নেতাজি মৃত। এ বিতর্ক এক হাজার বছর পরও চলতে থাকবে। এই নিয়ে আমার চর্চা নয়। যেহেতু তাঁর Death Certificate আমাদের হাতে নেই বা থাকলেও তা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাই ধরে নিচ্ছি নেতাজি আজও জীবিত আছেন। কোথাও না কোথাও হাঁটা চলা করছেন, ছোটবেলাকার যোগ অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যায় দেখলে চড় থাপ্পড় মারছেন (যেমন করে অধ্যাপক ওঁতেন সাহেবকে মেরেছিলেন), আরও কত কি! ধরে নিলাম আমাদের দেশের বা রাজ্যের এই পাহাড় প্রমাণঅনিয়ম বেনিয়ম দুর্নীতি (শিক্ষক নিয়োগ ও আবাস দুর্নীতি র মতো) মেনে নিতে না পেরে আত্মপ্রকাশ করলেন নেতাজি। সটান তাঁর কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। এবং হুঙ্কার দিলেন, আমি ভোটে দাঁড়াব। কী হবে বা কী হতে পারে? ভাবুন।
তিনি তো রাজনীতির লোক। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার লোক নন তিনি। তাঁর প্ৰিয় প্রতীক চিহ্ন সিংহ নিয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। অবশ্যই তাঁর নিজের দল ফরওয়ার্ড ব্লক তাঁর পাশে থাকবেন। অবশ্য বর্তমানে এই দলটির যা অবস্থা তার উপর ভরসা না রেখে নির্দল হয়ে দাঁড়াতে পারেন সুভাষবাবু। বা আজকের কোন না কোন একটি বড় দল বেছে নিতে পারেন। প্রথমে ধরে নিই তাঁর জীবনের প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস যদিও সেই দলের বদলে কংগ্রেস (ই ) এখন জাতীয় কংগ্রেসের তকমা পেয়ে বসে আছে। একে তো কংগ্রেস এখন ভীষণ নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। নেতাজির হাত ধরে কংগ্রেস অক্সিজেন পেলেও পেতে পারে। ধরে নিলাম নেতাজির ছোঁয়ায় কংগ্রেস চাঙ্গা হয়ে উঠল। জয়ের ঝড় উঠল। বিজেপি ছেড়ে দেবে? এই যে তাঁর জন্মদিন এত ভালো ভালো কথা আওড়ালেন মোদী থেকে শাহ, শুভেন্দু থেকে দিলীপ তখন নেতাজি নিয়ে কী বলবেন? তাঁর বিরুদ্ধে একজন কে খাড়া করে কাঁচা খিস্তির ঝুলি থেকে প্রথম যে শব্দটি বের করবেন মোদীরা তা হোল দেশদ্রোহী। ব্যস, ঘাটালের বিজেপি বিধায়ক শীতল কপাটও বলতে শুরু করবেন এক দেশদ্রোহী এসেছে ভোট চাইতে। আরও কত কী! আমরা সাধারণ আম পাবলিক আমতা আমতা করে বিশ্বাস করেই ফেলবো নেতাজি দেশদ্রোহী অতএব ‘নোভোট’। আর যদি বিজেপির প্রতীক পদ্ম নিয়ে ভোটে দাঁড়ান নেতাজি, তখন কী বলবেন কংগ্রেস নেতারা ? কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বলবেন, সুভাষ বসুকে দলবিরোধী কাজের জন্য অনেক আগেই কংগ্রেস থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। একগুঁয়েমির জন্য বারবার দল বিপদে পড়েছে। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে পর্যন্ত মানেননি যে লোক সে করবে দেশের কাজ। হঠাৎ হটাৎ করে বিদেশী ফেসিষ্ট শক্তির হাত ধরতে পাড়ি দেবে। মনে করুন, কংগ্রেসের ভিতরে গণতন্ত্র দাবি করার মূল্য দিতে হয়েছিল সুভাষকে। ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের হাইকমান্ড সুভাষচন্দ্রের কোনও নির্বাচনী আসন গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। সুভাষ কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে কী দাঁড়ালো? নেতাজিকে যদি সত্যিই শ্রদ্ধা করা হয়, যদি তাঁর অবদান কে স্বীকার করে নিতেই হয় তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিলেই তো হয়। কিন্তু দেশের বর্তমান নোংরা রাজনীতির চোরাস্রোতে নেতাজির মতো লোকও খাবি খাবেন। নির্দল প্রাথী সুভাষ জিততে পারবেন?
এবার চলে আসি আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এখন তৃণমূলের যা রমরমা বাজার সুভাষকে জিততে হলে ঘাসফুল দলে নাম লেখাতেই হবে। তখন কী ছেড়ে দেবে বিজেপি আর সিপিএম সিপিআই হাতের কাছে তো “তোজোর কুত্তা” শব্দ তো আছেই আরও কত কী শব্দ বেরোয় কে জানে? যদিও তাঁর ঘনিষ্ট মহল দাবি করেন, সুভাষ নিজেকে বামপন্থী ও সমাজবাদী বলে ভাবতেন। যদি ধরে নিই সুভাষ সিপিএম জোটের প্রার্থী হলেন সামনের লোকসভা ভোটে। তাহলে কী ছেড়ে দিবেন তৃণমূলের অগ্নিকন্যা বা কুণাল ঘোষ বা রাজ্য রাজনীতিতে খ্যাত ভাইপো অভিষেক? তাছাড়া তৃণমূলের যা জোয়ার বা লক্ষ্মী ভাণ্ডারের যা তেজ বামপন্থী জোটের প্রার্থী সুভাষ গোহারান হারতে কতক্ষণ? তাঁর অনুপস্থিতিতে কত ভালো ভালো কথা সে সব উধাও হয়ে যাবে নোংরা রাজনীতির যাঁতাকলে। তিনি তখন হয়ে উঠবেন বৃদ্ধ জোরাদ্গব। এই নেতাজির বিরুদ্ধে খিস্তির বন্যা বয়ে যাবে। কেন বলছি? মনে করুন ২০০২ সালে নেতাজির ডান হাত বলে পরিচিতি স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহাগাল রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। দেশের বেশিরভাগ বিধায়ক সাংসদরা তাঁকে ভোট দেননি। তিনি গোহারা হেরে গিয়েছিলেন। বিপ্লবী গণেশ ঘোষ বা তমলুকের স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ সামন্ত বা দাসপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামী মৃগেন ভট্টাচার্যকে সহজে আসন ছেড়ে দেয়নি আম জনতা। এঁরা সবাই নির্বাচনে জিতেছিলেন শাসকদলের প্রতীকে। তাঁদের সম্মান জানিয়ে সংসদ বা বিধানসভায় আমরা পাঠাই না। তেমনই নেতাজির ক্ষেত্রেও তাই হতে বাধ্য। আসলে নেতাজিকে নিয়ে আমরা রাজনীতি করছি। যে রাজনৈতিক দলগুলি এত গদগদ চিত্ত তা সব লোকদেখানো। তা না হলে কেন্দ্রের কোন শাসকদল কেন রাষ্ট্রসংঘে লিপিবদ্ধ নেতাজিকে “যুদ্ধপরাধী” তকমা ঘোচাতে উদ্যোগী হচ্ছে না? এই ১২৬ বছর বয়সে ফিরে এলেই নেতাজিকে তুলে দিতে হবে রাষ্ট্রসংঘের হাতে। আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় বিচার হবে আমাদের প্ৰিয় নেতাজির। হয়তো এই কারণেই তিনি লোকালয়ে আসছেন না!