সৌমেন মিশ্র, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল: বিজ্ঞান যেখানে যুক্তি খুঁজে পায় না, তথ্য হারায় সেখানেই মানুষ তার বিশ্বাসে ভরদিয়ে দ্বারস্থ হয় ভগবানের। আমাদের মধ্যেকার কিছু সাধারণ মানুষও তার কর্মকাণ্ড জীবনের কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার জেরে ধীরে ধীরে দেবতার আসনে স্থান পান। পরে তাঁর অনুপস্থিতিতেও সাধারণ মানুষ তাঁকে স্মরণ করে নিজেদের মনোবল বাড়ায় তাতে বাড়ে আত্মবিশ্বাস। হয়তো সেই বিশ্বাস থেকেই আজ ২০০ বছর পরেও লক্ষাধিক ভক্তের মাঝে রয়ে গেছেন দাসপুর ১ ব্লকে কাঁসাই পাড়ে যদুপুরের সেই আখড়া বাবাজী। প্রতি ৫ বৎসর অন্তর দোল পূর্ণিমা তিথিতে যদুপুরে ব্রজোবিনোদ মন্দিরে আয়োজন হয়ে আসছে মহোৎসবের৷ মাঝে করোনার জেরে বন্ধ ছিল মহোৎসব। এবার ২০২৩ সালের ৮ ও ৯ মার্চ বুধ ও বৃহস্পতিবার ৭ বৎসর পর আবার আখড়া বাবাজীর আখড়ায় ব্রজোবিনোদ জিউ ধামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে লক্ষাধিক ভক্তের সমাগমে মহোৎসব। কে এই আখড়া বাবাজী?
কী তাঁর মাহাত্ম্য। ২০০ বছরেরও আগে যদুপুরে কী ঘটনা ঘটেছিল যার জেরে এই আখড়াবাবাজীর এত ভক্তের ঢল?যদুপুরেরই বাসিন্দা পাশাপাশি রাজনগর ইউনিয়ন হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কানাইলাল অধিকারী প্রথম এই আখড়াবাবাজীর বিষয়ে সমস্ত তথ্য উদ্ধার করেন। তাঁর লেখা বিভিন্ন বই বা তথ্য বলছে আনুমানিক ২০০ বছরেরও আগে বর্তমান দাসপুরের এই যদুপুর গ্রামের বিজয় মাইতি, অজয় মাইতি, নিমাই মাইতি, নিতাই মাইতি, প্রবোধ মাইতি বা সনাতন মাইতির পরিবারে ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন বৃন্দাবন মাইতি। তখন স্বচ্ছল ছিল ওই মাইতি পরিবার। তবে পুত্র সন্তান না থাকায় পরিবার মানসিকভেবে ভেঙে পড়ে। আনুমানিক ১২০০ বঙ্গাব্দ ইংরেজি ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দের মাঘ মাসের কোনও এক পুণ্য তিথিতে বৃন্দাবন মাইতি এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। সেই সময়ই ওই মাইতি পরিবারের দুয়ারে হাজির হন এক অবাঙ্গালি বৈষ্ণব সাধক, তাঁর সাথে ছিলেন কয়েকজন তাঁরই অনুগত ভক্ত। তাঁরা জানান, বৃন্দাবনধাম থেকে তাঁদের আগমন। দুপুরের আহার সারতে চান ওই বৈষ্ণব সাধক। পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দের মাঝেই ভারাক্রান্ত বৃন্দাবনবাবু জানান, বাড়িতে জন্ম অশৌচ, কীভাবে তাঁরা সাধকদের সেবা করবেন? তখন ওই বাবাজী মহারাজ জানান, বাড়িতে অতিথি এসেছে তাদের সেবাই ধর্ম। বাবাজী ও তাঁর দলবল বৃন্দাবনবাবুর বাড়িতে সেবা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে নবজাতকের নাম দেন আনন্দ। পরিবারকে নির্দেশ দেন আনন্দ করতে। সেই থেকেই যদুপুরের মাইতি পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন। পরে ওই পরিবারের দেওয়া জমিতেই কাঁসাই নদীর পাড়ে ব্রজবিনোদ জিউ মন্দিরে বাবাজি তাঁর আখড়া বসান। সেখানে নিয়মিত ধর্মালোচনা চলত। ১ কী ২ বৎসর অন্তর তখন অন্ন মহোৎসব এর আয়োজন ছিল। এরই মাঝে বাবাজী ক্রমশ আখড়া বাবাজী নামে পরিচিত হতে থাকেন। তাঁর সম্বন্ধে নানান অলৌকিক কাহিনী ভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাবাজী মহারাজ কিছু শিষ্যকে আখড়ার দায়িত্ব দিয়ে অন্য শিষ্যদের নিয়ে তীর্থ পর্যটন এবং অর্থ সংগ্রহে বেরিয়ে যেতেই। বছরের শেষে আখড়ায় ফিরে সেই অর্থে ও গ্রাময়াবসীদের আর্থিক সহায়তায় যদুপুরের ওই আখড়ায় মহোৎসব করতেন। জানা যাচ্ছে আনুমানিক ১২৪০ বঙ্গাব্দে ইংরেজি ১৮৩৪ খ্রীস্টাব্দ,উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ্যের শেষভাগ থেকে বাবাজী মহারাজের আখড়ায় আর দেখা মেলেনি। তবে জনশ্রুতি আছে এর পরই বাবাজী মহারাজ বৃন্দাবন ফেরৎ ভক্তদের সাথে রাস্তার মাঝেই আখড়া বাবাজী দেখা করেন এবং তাঁদেরকে জানান তিনি বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন আর ফিরবেন না। এবং ওই ভক্তদের নির্দেশ দেন বিষয়টি আখড়ায় জানিয়ে দিতে। তিনি আরও জানান আখড়ার ওই আশ্রমের কুলুঙ্গিতে কিছু অর্থ আছে। সেই অর্থ মন্দির নির্মান ও মহোৎসবের আয়োজনে খরচ করতে। বাবাজীর কথা মতো ওই ভক্তরা আখড়ায় সমস্ত বিষয় জানান এবং কুলুঙ্গি থেকে বেশকিছু অর্থ উদ্ধার হয়। আনুমানিক ১২৪০ বঙ্গাব্দে বাবাজীর পারলৌকিক ক্রিয়া, নাম যজ্ঞ মহোৎসব এবং বর্তমানের এই বাবাজীর স্মৃতি মন্দির নির্মিত হয়। সেই থেকেই বাবাজী মহারেজের শিষ্য প্রশিষ্যদের দ্বারা ওই মন্দিরে নিত্য সেবা এবং মাঝে মাঝেই নাম যজ্ঞ ও অন্ন মহোৎসবের আয়োজন হয়। ১৩৪০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত আখড়াবাবাজীর সেবক বা পূজক ছিলেন তাঁর শিষ্য বা অনু শিষ্য রামদাস বাবাজী। জানা গেছে তিনিই ঐ পরম্পরায় সর্বশেষ পূজক ছিলেন।
পরে গ্রামেরই অধিকারী পরিবার বংশ পরম্পরায় বাবাজীর নিত্যসেবায় নিয়জিত হয়। সেই পরিবারের মদনমোহন অধিকারী ৬৬ বৎসর বয়সে এখন বাবাজীর নিত্যসেবার কাজে যুক্ত।
যদুপুরের যে মাইতি পরিবারে বাবাজী প্রথম আগমন সেই পরিবারের বর্তমান সদস্য বিজয় মাইতি জানান আখড়াবাবাজীকে নিয়ে নানান অলৌকিক কথা। এবার ২০২৩ এ ৮ ও ৯ ই মার্চ আখড়াবাবাজীর আখড়া স্থানেই মহোৎসবের আয়োজন। বর্তমান কমিটির পক্ষে পুলিন সামন্ত জানান লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হবে এবার মহোৎসবে। প্রশাসনের তরফে স্বাস্থ্য পরিসেবা, পানীয়জল আপদকালীন এম্বুলেন্স সমস্ত ব্যবস্থায় রাখা থাকছে। কীভাবে আসবেন এই মন্দির ও উৎসব প্রাঙ্গণে? ঘাটাল পাঁশকুড়া সড়ক বা ঘটাল মেদিনীপুর সড়ক ধরে সোজা বেলতলা বা রাজনগর। রাজনগর থেকে কাঁসাই নদীর বাঁধ ধরে যদুপুর আখড়া বাবাজীর মন্দির প্রায় ৩ কিলোমিটার। চওড়া বাঁধ, বাইক প্রাইভেটকারের মতো সমস্ত ধরনের গাড়িতেই যাতায়াত করা যাবে। রাজনগর, বেলতলা এসব এলাকা থেকে থাকছে টোটোর ব্যবস্থাও।