চৌধুরী সামসুল আলম: একটা কবিতাতে পড়েছিলাম। একজন মুটে বলছে, যদি তার কোনও দিন অনেক টাকাকড়ি হয় তাহলে সে শহর জুড়ে রাখবে গদি মুড়ে। কারণটা হল, সে যখন পসরায় বোঝাই করা ঝাঁকা মাথায় করে শহরের অলিগলি তে ঘুরে ঘুরে ফেরি করে তখন শহরের পাকা রাস্তার শক্ত জমিনে তার পায়ে ব্যথা হয়। তাই যাতে তার পায়ে না ব্যথা হয় তার জন্য সে শহরের সারা রাস্তায় গদি বিছিয়ে দিবে। তার মাথায় কিন্তু এই ভাবনাটা এলো না যে যদি তার এত টাকাকড়িই থাকে তাহলে সে মোট বইবে কেন?
আমার বক্তব্যটাও অত্যন্ত সহজ ও সাধারণ। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি ঘোষণা করেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জন্য তিনি স্বাস্থ্য সাথী পয়লা ডিসেম্বর ২০২০থেকে চালু করবেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব-ধনী নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে, নার্সিংহোমে চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। এক একটি পরিবারের চিকিৎসার জন্য বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ চিকিৎসার সুযোগ পাবে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রচারটা খুবই মুখরোচক, লোকজন ভালোই গিলবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের কফিনের শেষ পেরেকটা দিদিমণি সিঙ্গুরে টাটাকে তাড়িয়ে পুঁতে দিয়েছেন। বছরের পর বছর শুধুই প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমা হচ্ছে। নিয়োগ নাই। সরকারি কর্মচারি-শিক্ষকেরা ক্রমাগত বঞ্চনার শিকার, চাষির ফসলের দাম নাই। সর্বোপরি মানুষের না আজ আর্থিক, না আছে সামাজিক নিরাপত্তা। মানুষের শ্রমকিঙ্কন দু’দুটো হাত আর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ককে অকেজো করে তাকে কখনও অনুকম্পা,কখনও অনুপ্রেরণার গ্রহীতা করে এই মুখ্যমন্ত্রী রাখতে চান।
কেন? কেন?—কেন এই ভিক্ষাবৃত্তি বঙ্গবাসীকে গ্রহণ করতে আপনি বাধ্য করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি কি জবাব দিতে পারবেন? সত্যিই যদি মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে চান তাহলে কেন সেটা সরকারি হাসপাতালগুলোতে নয়? প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামোগুলোকে যদি উন্নত করা যায়, চিকিৎসক চিকিৎসাকর্মী যদি যথাযথভাবে নিয়োগ করা হয় তাহলে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প নতুনভাবে ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
এবার বলি অন্য একটা কথা। পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে ১০ কোটি মানুষের বাস। তার পাঁচ শতাংশ হলো প্রায় ৫০ হাজার। সাড়ে ১০ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার লোকের জন্য বছরে গড়ে দু’লাখ টাকা করে খরচ হলে খরচ হবে এক লক্ষ কোটি টাকা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবছরে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রেখেছেন মাত্র আট হাজার চারশো একানব্বই কোটি টাকা। যেটা ওই তুলনায় নস্যি বলা যেতে পারে। সামনে বিধানসভা নির্বাচন। উনি নিজেই বলেছেন উনি নাকি গুণ্ডা কন্ট্রোল করেন। তাঁর পারিষদবর্গ থেকে তার অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত প্রাণেরা কেউ মার্ডারার, কেউ দাগী আসামী, কেউ সিন্ডিকেটের নায়ক, মাটিমাফিয়া-এই সব লোক জন। এদের নিয়েই তাঁর কারবার। যে বিষধর কালাচ, খরিস, চন্দ্রবোড়াদের নিয়ে, যে সমাজবিরোধীদের নিয়ে তাঁর কারবার আজ তাঁরা তাকেই দংশন করতে উদ্যত। উনি দিশেহারা। তাই একদিন উনি সিঙ্গুরে কৃষকদের যে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সরকারি কর্মচারিদের সেন্ট পার্সেন্ট কেন্দ্রীয় হারে বেতন-ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটা যে নিছক একটা ধাপ্পাবাজি আজ প্রমাণিত। তাই আবার এক নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন প্রতারণা। যদি উনি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতে চাইতেন সেটা সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে দিতে পারতেন। উনি হয়তো ভাবছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষগুলো হয়তো সেই বোকা মুটে। ওর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান এককথায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে স্বাস্থ্যসাথীর মতোই যদি শহরজুড়ে গদি মুড়ে রাখার গল্প বললে মানুষ তার কথায় আর একবার ভুলে যাবে। আবার একটা নির্বাচনী বৈতরণী পার। তারপর নতুন গপ্পো! কেন্দ্রের বঞ্চনা! আবার খেলা, মেলা, ক্লাবগুলোকে,পুজো কমিটিগুলোকে টাকা বরাদ্দ। তার থেকে পার্সেন্টেজ কেটে পাটিফান্ড তৈরি। সরকারি কর্মচারিদের ঘেউ ঘেউ কুত্তার আওয়াজ। আবার পাঁচ পাঁচটা বছর।
ভাবুন-ভালো করে ভাবুন। প্রতারণায় পা দেবেন না এই ১০ বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে শাসকের ধাপ্পাবাজির উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নেবেন!
•প্রতিবেদক পরিচিতি: চৌধুরী সামসুল আলমের বাড়ি চন্দ্রকোণা থানার নেকড়বাগে। ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব।