অভিজিৎ কাপাস,রাজনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর: ২০২০ সাল।মার্চের মাঝামাঝি। হঠাৎ যখন স্কুলে অকাল বোধনের ন্যায় অকাল ছুটি পড়ল বেশ খুশিই হয়েছিল ছেলেমেয়েরা । শিক্ষক-শিক্ষিকারা পর্যন্ত না খুশি হয়ে পারেননি। ছুটি সকলেই চায়। আবার ছুটি যদি পড়ে পাওয়া হয়,তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু ছুটির সুখ যখন অসুখে পরিণত হল, তখন খাঁচায় বন্দী পাখির মত ছুটির খাঁচা থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছে পড়ুয়া ও শিক্ষক উভয়েই। দেখতে দেখতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহ দুয়ারে তালা ঝুলছে পড়ুয়াদের জন্য। করোনার করাল গ্রাসে তস্ত্র ধরণী।মানুষ বাঁচতে চায়। তাই অচেনা ঘাতক অতিথি করোনার হাত থেকে রক্ষা পেতে সারা পৃথিবীর মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিল । অনেককেই বাইরে যাওয়ার অনুমতি পরিস্থিতি অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও পড়ুয়াদের স্কুলে ফিরে আসার ছাড়পত্র মেলেনি।
কেমন করে দিন কাটছে স্কুল পড়ুয়াদের? তাঁরা সবাই বই পাড়াতেই আছে নাকি নেট পাড়ার নাগরিক হয়ে গেছেন? পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়া নেই,কোচিং সেন্টার বন্ধ, খেলার মাঠে নিষেধের বোর্ড। আগে পাশ ফেল ছিল না, এখন পরীক্ষা পর্যন্ত উধাও । অতএব পড়ে কোন বোকা? করোনার সবচেয়ে বড় অভিঘাত নেমে এসেছে শিক্ষার ওপর। অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে।বেকারত্ব বেড়ে চলেছে।গরীব গরীবতর হয়েছে।এই সকল অনস্বীকার্য। তবে এই সকল ব্যধি আরোগ্যলাভ করতে পারে ঠিকঠাক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া গেলে।কিন্তু করোনা অতিমারির দাপটে শিক্ষায় যে খামতি তৈরি হয়ে চলেছে,তাতে একটি জাতি সুদীর্ঘকাল ভুগতে থাকবে।
ছুটির আনন্দে যে পড়ুয়া খুশিতে ডগমগ ছিল, কিছুদিন পর সে ভাতের অভাবে ধুঁকতে শুরু করল।করোনা তার বাবার কাজ কেড়ে নিয়েছে। সে এখন মায়ের সাথে আনাজ বিক্রি করে হাটে হাটে।কেউবা অনাথ হয়েছে বাবা-মা উভয়কেই হারিয়েছে। করোনা ‘পরিযায়ী’ নামক এক নতুন শব্দের জন্ম দিয়েছে। অনেক মানুষের বিশেষণ এখন পরিযায়ী। তা সেই পরিযায়ীদের অনেকেই সকার থেকে বেকার হয়েছে। সেই বেকারদের পরিবারে পড়াশোনা করা বিলাসিতার সমান। তারপরেও আছে।যারা মাথায় একটু লম্বা হয়েছিল,বয়সে একটু বড়। অনেক পরিবার সেই সকল কিশোরদের কাছ থেকে বইখাতা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি স্বপ্নের কৈশোরকাল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে।কাজের দেশে গিয়ে ভিড়েছে, স্কুলবেলা ফেলে হাজার হাজার পড়ুয়া। আবার কিশোরীদের কথা না উল্লেখ করলেই নয়।আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ বাল্য বিবাহ রোধে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই স্কুল বন্ধের কালে কত কিশোরী বাধ্য হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে তার পরিসংখ্যান জানলে আমাদের লজ্জা পেয়ে বসবে।
মোট কথা স্কুল তাদের অসংখ্য সন্তান-সন্ততিকে অকালে হারিয়েছে।তাদের অনেকের মধ্যেই যে সম্ভাবনার বীজ প্রথিত ছিলনা তা কেউ বলতে পারবেনা। স্কুলছুট হওয়ার সমস্যা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার পাশাপাশি ‘ডিজিটালাইজড বিভাজন’ বা বিভেদ রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা অর্জিত বিদ্যা ভুলে গেছে।অন্যদিকে ‘অপরচুনিষ্ট’ বা সৌভাগ্যবান যাঁরা তাঁরা প্রযুক্তির সুফলকে কাজে লাগিয়ে অনেক এগিয়ে গেল। মিড ডে মিলের প্রত্যাশা নিয়ে যারা স্কুল আসতো তাদের পুষ্টির ঘরে নিশ্চয়ই ফাঁক থাকবেই। শিক্ষকদের অনভ্যাসে দক্ষতা খর্ব হবে না তো? আরও অনেক রকম সমস্যাদীর্ণ হবে আগামীকালের শিক্ষার পথচলায়।
এক বছর আগে স্কুলে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়েছিল বোবা কান্নায়। আবার এসে গেল শিক্ষক দিবস। এই বছরও দিনটি পালিত হবে নির্জনতায়, নিস্তব্ধতায় ও হতাশায় ভর করে। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় স্কুল খোলার একটা ক্ষীণ আশার রেখা দেখা যাচ্ছে। যদি করোনা মানবজাতিকে ক্ষমা করে, যদি আবার স্কুল খুলে,তবে সব পড়ুয়াদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষক দিবসে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে উঠে আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসব মুখরতায়। এবারও উৎসবহীন শিক্ষক দিবস। করোনায় অভিশপ্ত শিক্ষার শাপমুক্তি ঘটতে পারে শিক্ষক জাতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। তাই এবারের শিক্ষক দিবসে শিক্ষক সমাজকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে সব পড়ুয়াদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে, শিক্ষায় বিভাজন রেখা দূর করতে এবং শিক্ষাঙ্গনকে ঐতিহ্যের পূর্বাপর অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।