“গোপালপুর চক্রবর্তী বাড়ির রাসমঞ্চ ও শিবমন্দির” — উমাশংকর নিয়োগী
♦আসুন আজ আমরা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার গোপালপুর যাব। পাঁশকুড়া অথবা ঘাটাল থেকে ঘাটাল-পাঁশকুড়া রাস্তা ধরে বেলিয়াঘাটায় নামুন। বেলিয়াঘাটার পূর্ব দিকে গোপালপুর মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে [ক্লিক করুন:👉 পথ নির্দেশ]। টোট চলছে । বেলাঘাটার ভিতর দিয়ে গোপালপুরের স্কুল পেরিয়ে বাবুদের (চক্রবর্তী) বাড়ির [লোকেশন:📍 ক্লিক করুন] সামনে পৌঁছাতে বড়জোর মিনিট দশেক লাগবে। সব রাস্তাটাই পিচ অথবা কংক্রিটের । গাড়ি নিয়েও আসতে পারেন ।
সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছাতে পারলে দেখবেন এদের পারিবারিক দেবালয়ে দামোদরজিউ, শ্রীকৃষ্ণ-রাধিকা,আর গোপালের পুজো হচ্ছে । চারশো বছরেরও বেশি পুরনো কড়ি-বরগার পশ্চিমমুখী চাঁদনি মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল । প্রাচীন মন্দির স্থলে ভক্তদের দানে ও পরিবারের সদস্যগণের পুর্ণ সহযোগিতায় অতি সম্প্রতি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ১৪২৭ সালে দক্ষিণমুখী নোতুন মন্দির, ভোগশালা ইত্যাদি হয়েছে। এঁদের পরিবারের সদস্যদের কাছে জানা গেল তিনশো বছর আগে পরিবারের জমিদারি ছিল। অনেকে বলেন এঁরা বর্ধমান রাজার নায়েব ছিলেন । মূলত জমির আয়ে ঠাকুর সেবা চলত। কিন্তু জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদ ও ভারত সরকারের দ্বারা জমির শিলিং বেঁধে দেওয়ার ফলে অধিকাংশ জমি ভেস্ট হয়ে যায় । জমি থেকে আয় তলানিতে এসে ঠেকে । বর্তমানে দামোদরজিউর সামান্য জমির আয় ও পারিবারের সকলের সহযোগিতায় দেবসেবা চলছে ।
মন্দিরটির সামনে রাস্তা । রাস্তার পরেই একটি বড় পুকুর। পুকুরটির গভীরতা এখনো বজায় আছে। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে উত্তর ও দক্ষিণ মুখে ভুবনেশ্বর ও গগনেশ্বর নামে দুটি শিবলিঙ্গের আটচালা মন্দির । দুটি মন্দিরেই বেশ কিছু টেরেকোটার ফলক আছে । উত্তর দিকের মন্দিরটিতে প্রতিষ্ঠা ফলক আছে কিন্তু তা অস্পষ্টতার কারণে পাঠ করা না গেলেও দক্ষিণ দিকের মন্দিরে থাকা ফলকটি থেকে জানতে পারা যায়, ১৭০৭ শকাব্দে সন ১১৯৩ সালের ৪ঠা বৈশাখ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মন্দিরের নক্সা করা দরজাটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে । টেরেকোটা ও মন্দিরের গঠনশৈলী এক হলেও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে মন্দির দুটি একই সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাধারণ মানের টেরেকোটা ফলক দিয়ে মন্দির দুটি সজ্জিত হলেও এর বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মত ।
উত্তর দিকের মন্দিরটির সামনে দাঁড়ালে আপনার বাম দিকের দরজার পাশে উল্লম্ব ভাবে সাজানো টেরেকোটার একে বারে নীচে চোখে পড়বে সিদ্ধি ঘোঁটার ফলক , এর উপরে আছে কল্কি সহ দশাবতার । পূর্ব দিকের উল্লম্ব বরাবর দেখুন বেশ কয়েকটি মিথুন ফলক আছে । আর্চে লেঠেল , বন্দুকধারী সহ অন্যান্য ফলক আছে। এখানে প্রতিষ্ঠা ফলকটির পাঠোদ্ধার করা যায়নি। দরজার খিলানের উপরে শিবলিঙ্গ সহ মোট দশটি মন্দির আছে । প্রতিটি মন্দির শীর্ষে পতাকা আছে। উপরে টেরেকোটায় একটিতে রামচন্দ্র হরধনুতে ছিলা পরাতে উদ্যত । অন্যটিতে রামচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করছেন সঙ্গে হনুমান । সতীর দেহত্যাগ শিবের তাণ্ডব নৃত্য । সবার উপরে হরপার্বতী বসে আছেন ।সঙ্গে লক্ষ্মী ,সরস্বতী , কার্তিক ও গণেশ । হরপার্বতীর পাশে লক্ষ্মী – সরস্বতী, কার্তিক – গণেশ এমন ফলক সম্ভবত দাসপুরে আর কোন মন্দিরে নেই ।
চলুন , এবার দক্ষিণ দিকের মন্দিরটি দেখে নেওয়া যাক । আপনার ডানহাতি উল্লম্ব টেরেকোটা ফলকগুলি দেখুন । এখানে আছে শিশু গণেশ কোলে গণেশ জননী , মহাদেব তপস্যা করছেন , চতুর্ভুজ দেবী কালী হাতে খাঁড়া , নরমুণ্ড নিয়ে শিবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন । আছে কৃষ্ণরাধিকার মূর্তি সহ অন্যান্য দেবদেবী ফলক । বাঁ দিকের উল্লম্ব ফলকগুলিতে মণি মূর্তি সহ কয়েকটি মিথুন মূর্তি আছে। উপরে আর্চে প্রতিষ্ঠা ফলক সহ লাঠিয়াল , তীরন্দাজ , ঢাল তরোয়ালধারী ও বন্দুকধারী সৈন্য সহ অন্যান্য ফলক আছে। দরজার খিলানে দশটি শিব মন্দির উত্তর দিকের মন্দিরটির অনুরূপ । লক্ষ্মণের শক্তিশেল , হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনা , এর উপরে রাম রাবণের যুদ্ধ , বালি সুগ্রীবের লড়াই ।
প্রতিটি মন্দিরে দুটি করে দরজা ও প্রতি দরজায় দুজন করে দৌবারিক আছে। একটি দ্বারপাল কৌপীনধারী । অন্য গুলি নগ্ন । কোনটির জননাঙ্গ আছে কোনটির বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একজন একপায়ে দাঁড়িয়ে , অন্য একটি তো আবার জননাঙ্গ মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন । এরা কী নাগা সন্ন্যাসী? নাকি জৈন মূর্তি । এদের মাথা ও কান জৈন মূর্তির মত। এক সময়ে দাসপুর এলাকায় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিজয় চিহ্নিত করার জন্য শিব মন্দিরে জৈন দ্বারপাল মূর্তি দাঁড় করানো নেই তো ? দ্বারপালের মূর্তি সমূহ কী সংযমের প্রতীক ? হবেও বা !
গোপালপুরের বাবুদের মন্দিরগুলির মধ্যে কৌতূহলী দর্শকের কাছে সব থেকে আকর্ষণীয় পূর্বমুখী দৃষ্টিনন্দন নবরত্ন দোল বা রাসমঞ্চটি । মন্দিরের সম্মুখের মতই উত্তর ও দক্ষিণ দিকে তিনটি খিলানের অলিন্দ আছে। দোল ও রাসের সময় মঞ্চ প্রাঙ্গণ প্রচুর ভক্ত সমাগমে এখনো উৎসব মুখর হয়ে উঠে । দামোদর , শ্রীকৃষ্ণ , রাধিকা , গোপাল মঞ্চে আসেন । ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন গোপাল । নবরত্নটির উপরে উঠার সিঁড়ি আছে । রাসমঞ্চে কোথাও সন তারিখের উল্লেখ নেই। তবে অনুমান করা যেতে পারে শিবমন্দির দুটির সমসাময়িক হলে চুনসুরকি ইট দিয়ে তৈরি মঞ্চটি প্রায় দুশো চল্লিশ বছর আগে নির্মিত এবং এখনো প্রায় অক্ষতই । মঞ্চটির সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল উত্তরপুর্ব ও দক্ষিণপূর্ব কোণে নফুট করে দুটি মৃত্যুলতার টেরেকোটা প্যানেল । এতবড় মৃত্যুলতা দাসপুর বা ঘাটালের কোন মন্দিরে, বা রথে চোখে পড়েনি । উত্তরপূর্ব কোণের মৃত্যু লতায় অক্রুরের রথে করে কৃষ্ণকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি ফলক আছে। নরনারী, শিশু ও পশুমূর্তি সহ মৃত্যুলতাটি দর্শনীয় । ভাবতে অবাক লাগে , রাস ও দোল দুটি আপাত দৃষ্টিতে আনন্দের, নরনারীর মিলনের উৎসব । যে মঞ্চের সামনে নরনারী মিলনে মাতে তার দেওয়ালে মৃত্যুলতা ! বোধহয় প্রতিষ্ঠাতারা বোঝাতে চেয়েছেন, জীবনের উদ্যানে মরণের ফুল ফোটা অনিবার্য । হেসে নাও দুদিন বইতো নয় , কী জানি কখন সন্ধে হয় ! দোলমঞ্চটি ও শিবালয় দুটি আমাদের মহকুমার গর্ব।
•কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গোপালপুরের বাসিন্দা সুধীরচন্দ্র চক্রবর্তী, কেদারচন্দ্র চক্রবর্তী,দেবাশিস চক্রবর্তী এবং বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী