‘মহালয়া’ —উমাশংকর নিয়োগী
•বর্তমান সময়ে শিক্ষায় ,আর্থিক ও সামাজিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়েদের অতি সুন্দর ব্যবহারে একটা বড় অংশের বাবামা বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পছন্দ করছেন । বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা ক্রম বর্ধমান। এই সব সন্তানেরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যয়ভার বহন করে পিতামাতার প্রতি কর্তব্য করলাম মনে করে পরম তৃপ্তিলাভ করে। অর্থবান , রোজগারি বা বেরোজগারি অথর্ব বাবা মা বেশির ভাগ পুত্র কন্যাদের কাছে আজ সিন্ধাবাদের কাঁধে চড়া জিন স্বরূপ।
মহালয়ার দিন গঙ্গার ঘাটে ঘাটে,শত শত নদীঘাটে, জলাশয়ে পরলোকগত পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধালুদের তর্পণ করার হিড়িক পড়ে যায়। এদের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশের বেশির কাছে বাবা মা জীবদ্দশায় চরম অবহেলার ,অবজ্ঞার পাত্র ছিল। এক সময়ে বাবামায়ের মৃত্যু কামনায় দিন গুণে গুণে তাদের আঙুল সরু হয়ে গিয়েছিল। এরা কেবল জনমানসে নিজেদের পিতৃমাতৃ ভক্ত রূপে প্রতিপন্ন করার তাগিদে মহালয়ায় তর্পণ করে। গঙ্গা জলে নাভি পর্যন্ত ডুবিয়ে পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দেবার সময়েও অন্য চিন্তায় ব্যাপৃত থাকে। আর যারা নিজেদের পিতামাতার বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট মনে করে তাদের কাছে তর্পণাদির তো কোন মূল্যই নেই। যাক গে ওসব ছেঁদো কথা। তর্পণ কাকে বলে ? মহালয়া কী ও কেন সেই প্রসঙ্গে আসা যাক ।
তর্পণ কী? আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি আত্মা অবিনশ্বর। একে ধ্বংস করা যায় না । দেহের বিনাশ ঘটে, দেহ নষ্ট হয় কিন্তু আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এই নতুন দেহ গ্রহণের পূর্বে আত্মা নিজ নিজ কর্মফল অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন লোকে থাকে। পিতৃলোক এমনি একটি লোক যেখানে আমাদের মৃত পূর্ব পুরুষেরা অবস্থান করেন। এই পিতৃলোকে অবস্থানরত পূর্ব পুরুষদের তৃপ্তির উদ্দেশ্যে জলদান করাকেই তর্পণ বলে। তর্পণ দু রকমের , প্রধান ও অঙ্গ। স্নান না করেও প্রতিদিন আমাদের স্বর্গত পিতামাতাকে স্মরণ করার যে বিধান শাস্ত্রে আছে তাকে প্রধান তর্পণ বলে। আর স্নান করে যে তর্পণ করা হয় তাকে অঙ্গ তর্পণ বলে। অঙ্গ তর্পণের আবার তিন প্রকার। নিত্য , নৈমিত্তিক ও কাম্য তর্পণ । স্নান সেরে নিত্য বা নৈমিত্তিক বা কাম্যতর্পণ করার পর প্রধানতর্পণ করতে হয় না । আবার নৈমিত্তিক বা কাম্য তর্পণ করার পর নিত্যতর্পণ করতে হয় না।
শাস্ত্র কাদের তর্পণের অধিকার দেয়নি ? যে সব ব্রাহ্মণ বালকের উপনয়ন হয়নি, যাদের বাবা বেঁচে আছেন , যে সকল শূদ্রের বিয়ে হয়নি এবং স্ত্রীলোক এদের তর্পণের অধিকার নেই । কিন্তু কোন বিধবার যদি ছেলে বা নাতি না থাকে তবে সে স্বামী, শ্বশুর এবং শ্বশুরের পিতার জন্য তর্পণ করতে পারবে । পিতা মারা যাবার এক বছরের মধ্যে মহালয়াতে কেবল প্রেততর্পণ করা যায়।শাস্ত্রীয় নির্দেশ মেনে অপকর্ষ সপিণ্ডন হলে পিতা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যে মহালয়াতে পিতৃতর্পণ করা যায়। এক হাতে তর্পণ করা শাস্ত্র অনুমোদন করে না ।
মহালয়া কী ? মহালয়া শব্দটি দুটি শব্দ দিয়ে গঠিত । মহা + আলয় = মহালয়। স্ত্রী লিঙ্গে মহালয়া । মহালয় অর্থ সবথেকে বড় যে আশ্রয়স্থল। হিন্দুরা জন্মান্তর বাদে, পরলোকে বিশ্বাসী । আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আমারা ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মে লীন হয়ে যাই। কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন, “ তোহে জনমি পুন, তোহে সমাওত , সাগর -লহরী সমানা। ” ঋগ্বেদে প্রেতলোক বলে কিছু নেই। মৃত্যুর পরে পরেই মানুষ তার পূর্ব পুরুষেরা মৃত্যুর পর যে লোকে আশ্রয় পেয়েছেন সেই লোকেই সরাসরি চলে যায়। ঋগ্বেদে প্রার্থনা করা হয়েছে , “ প্রেহি প্রেহি পথিভিঃ পূর্ব্যেভির্যত্রা নঃ পূর্বে পিতরঃ পরেষুঃ । ” ঋগ্বেদ ১০। ১৪। ৭। কারোর মৃত্যুর পর বলা হত , পূর্বপুরুষেরা যে পথ দিয়ে যে স্থানে গিয়েছেন তুমিও সেই পথে যাও। ঋগ্বেদের ১০। ১৪ । ৮ মন্ত্রে মৃত্যুর পরেই মৃতকে স্বর্গে পিতৃগণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে স্মার্তরা ইহলোক ও স্বর্গের মধ্যে প্রেতলোকের, পিতৃলোকের অবস্থানের কথা বলেছেন। বর্তমানে হিন্দু মাত্রেই বিশ্বাস করে কোন মানুষের দেহান্ত হলে তাকে এক বছর প্রেতলোকে থাকতে হয়। মৃত্যুর পর থেকে সপিণ্ডকরণ পর্যন্ত পিণ্ড দানের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির তথা প্রেতের বায়বীয় শরীর গঠিতহয়। সমস্ত মৃতই এক বৎসর পর প্রেতলোক থেকে পিতৃলোকে যায়। জীব আত্মার ব্রহ্মে তথা পরমাত্মায় লীন হওয়া মহালয় প্রাপ্তি। বিশেষ দিনে উত্তর পুরুষের দেওয়া তিলজলে শক্তি সঞ্চারিত করে মহালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা । এই দিনটি মহালয়া ।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত কন্যা রাশিতে সূর্য অবস্থান করে।এই পক্ষকাল পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত । হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস, এই সময়ে পিতৃপুরুষগণ ব্রহ্মার নির্দেশে মর্ত্যের কাছাকাছি আসেন তাঁদের উত্তর পুরুষরা কেমন আছে তা দেখতে। তাদের দেওয়া জলে শক্তি সঞ্চয় করতে। তাঁরা উত্তর পুরুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধাযুক্ত সমন্ত্রক তিলজল কামনা করেন। পিতরঃ কথাটি কেবল মাতাপিতাকে বোঝায় না। আমাদের শাস্ত্রে পিতরঃ শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। পিতা মাতা মাতামহ মাতামহী সহ কোটি কোটি জন্মের তা যে জন্মই হোক না কেন, সেই সব পিতৃপক্ষ মাতৃপক্ষকেও পিতরঃ শব্দে বোঝায়। পিতৃলোক থেকে আগত পূর্বপুরুষেরা মহালয়া অমাবস্যার পর আবার স্বস্থানে ফিরে যান। কন্যা রাশিতে সূর্যের অবস্থান কালে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের যে কোনদিন পিতৃ তর্পণ করা চলে।
মহালয়ায় পিতৃতর্পণ কবে থেকে শুরু এর উৎস কোথায় তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারো কারো মতে – কোন এক সময়ে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় ঘটেছিল। জল প্লাবনে চরাচর প্লাবিত হয় । কোটি কোটি মানুষের সলিল সমাধি হয়েছিল। জল নেমে গেলে মহালয়ার অমাবস্যা তিথিতে পরলোকগত পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে যারা বেঁচে ছিল তারা স্তবস্তুতি ও প্রার্থনা করেছিল । সেই থেকে মহালয়ার দিন পিতৃ তর্পণ শুরু হয়েছে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে হিন্দুদের যে কোন শুভ কর্মের তিনটি পর্যায় । সুচনা – মূলকর্ম এবং দক্ষিণান্ত । সূচনা পর্বে পিতৃকুলকে স্মরণ করা হয়। একে নান্দীমুখ বলে। আমরা বিশ্বাস করি দেবী দুর্গা, অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুরকে দেবী পক্ষে পরাজিত করেছিলেন। দেবীপক্ষের সূচনা লগ্নে তাই অশুভনাশিনী দেবী দুর্গার আরাধনার পূর্বে পিতৃ পুরুষের স্মরণ করা হয়। মহালয়ার তর্পণ করা হয় । প্রধান তর্পণ দ্বারা সারা বছর ধরে পরলোকগত পিতামাতাকে স্মরণ করার কথা । আমাদের শাস্ত্রে বলেছে , ‘ পিতৃ দেব ভব’ মাতৃ দেব ভব । ’ জীবিত পিতা মাতা প্রত্যক্ষ দেবতা । তাঁদের সেবা করা পুত্রের কর্তব্য । সব অমাবস্যায় পিতৃ তর্পণ না হলেও শ্রাদ্ধাদি করার জন্য কৃষ্ণপক্ষের একাদশী বা অমাবস্যা প্রশস্ত ।
সুপ্রাচীন সভ্যতা প্রাচীন মিশরের মানুষ মৃত্যুর পরেও মৃতের সমস্ত জাগতিক জিনিসের প্রয়োজন হয় বলে বিশ্বাস করত। তাই তাদের মৃত দেহের মমি হত , পিরামিড বানাত। ইসলাম ধর্মে প্রতিদিন পীর ফকিরের মাজারে , শবেবরাতের দিন ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। গ্রামদেশে অনেকে শবেবরাতকে বাপদাদার পরব বলে থাকে । খ্রিস্টানরা পঁচিশে ডিসেম্বর মোমের বাতি দেয় পরলোকগত আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে । কবরে বাতি জ্বালে মৃতকে স্মরণ করে। পরলোক এবং পরলোকগত পিতৃ পুরুষের অস্তিত্বে পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলি কম বেশি বিশ্বাসী ।
মহালয়ার দিন তর্পণ করার সময় আমরা যেসব মন্ত্র উচ্চারণ করে জল দিয়ে থাকি সেগুলোর দুএকটা একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে।
দেবা যক্ষাস্তথা নাগা গন্ধর্ব্বাপ্সরসোঽসুরাঃ ।
ক্রূরাঃ সর্পাঃ সুপর্ণাশ্চ তরবো জিহ্মগাঃ খগাঃ ।
বিদ্যাধরা জলাধারাস্তথৈবাকাশগামিনঃ ।
নিরাহারাশ্চ যে জীবাঃ পাপে ধর্মেরতাশ্চ যে।
তেষামাপ্যয়নায়ৈতদ দীয়তে সলিলং ময়া ।
দেবতা, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসু্র, হিংস্র শ্বাপদ, সরীসৃ্প, বড়পাখি, গাছপালা , ধীরগামী জীব , পাখি, বিদ্যাধর , জলচর , খেচর , ভূতপ্রেত , পাপী, ধার্মিক, তাদের তৃপ্তির জন্য আমি জল দিচ্ছি।
অন্য একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে –
আব্রহ্মভুবনাল্লোকা দেবর্ষি- পিতৃ – মানবাঃ ।
তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্বেমাতৃ-মাতামহাদয়ঃ।
অতীত কুলকোটীনাং সপ্তদ্বীপনিবাসিনাং।
ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ং।
ব্রহ্মলোক পর্যন্ত যত লোক আছে সেই সব লোকে অবস্থিত মৃত যাবতীয় জীবকে, দেবতাদের , ঋষিদের , পিতৃগণদের , মৃত সমস্ত মানুষকে , পিতা পিতামহ মাতা মাতামহদের , অতীতে কোটি কোটি জন্মের পূর্ব পুরুষকে , সাতটি দ্বীপের সমস্ত মৃতের উদ্দেশ্যে জল দান করছি। আমার দেওয়া জলে ত্রিভুবনের সবাই তৃপ্ত হোক।
আর একটি মন্ত্রে জল দান করা হয় –
যেঽবান্ধবা বান্ধবা বা, যেঽন্যজন্মনি বান্ধবাঃ ।
তে তৃপ্তি মখিলাং যান্তু , চাস্মত্তোয়কাঙ্ক্ষিণঃ।
যে আমার বন্ধু নয়, যে আমার বন্ধু, যে আমার অন্য জন্মে বন্ধু ছিল এছাড়া নিখিলের যারাই আমার কাছে এই তর্পণের তিল জল প্রত্যাশী তারা আমার দেওয়া জলে তৃপ্ত হোক।
অনেকেই আমরা মনে করি এই সব তর্পণ করা বামুনদের রোজগারের পথ মাত্র। তারা এই মন্ত্রগুলির অর্থ অনুধাবন করে দেখতে পারেন আমাদের শাস্ত্র কতখানি উদার আর এতে বিশ্ব মানবিকতা আছে কিনা !